হুমায়ুনের আত্মীয়-সম্পর্কিত এক ভাই, এবং তার অশ্বারোহী বাহিনীর সেনাপতি, সুলেইমান মির্জা প্রথম নিজের মতামত প্রকাশ করে। বাহাদুর শাহকে মত দেয়াটা খুব একটা সহজ হবে না। সেটা করতে যাবার আগে নিজেদের শক্তি সামর্থ্যের বিষয়টা একটু বিবেচনা করা উচিত। আপনার মরহুম আব্বাজান যখন দিল্লী জয় করেছিলেন তখনকার কথা আলাদা ছিল, এখন আমাদের শত্রুর চেয়ে আমাদের সৈন্য সংখ্যা, আর যুদ্ধোপযোগী রণহস্তি আর ঘোড়ার সংখ্যা অনেকবেশী। সবগুলো প্রাণীই বেশ ভালোভাবেই প্রশিক্ষিত আর সৈন্যরা বিশ্বস্ত। বাহাদুর শাহের উপচে পড়া রাজকোষ থেকে লুণ্ঠিত দ্রব্যের সম্ভাবনা যুদ্ধের জন্য তাদের আগ্রহকে জোরদার করবে। কিন্তু হিন্দুস্তানে মোগলদের প্রথমবার আগমন আর এখনকার বাস্তবতার মাঝে একটা পার্থক্য রয়েছে। এইবার, কেবল আমরাই না- উভয়পক্ষের কাছেই কামান আর ম্যাচলক গাদাবন্দুক রয়েছে। সুলতান মক্কায় হজ্জ পালন করতে যেসব হজ্জযাত্রী খোলা সমুদ্র অতিক্রম করে সেখানে যায় আর দূরদুরান্ত থেকে আগত বণিককের দল যারা ক্যাম্বে আর সুরাটে অবস্থিত তার সমুদ্রবন্দরে আশেপাশে ভীড় করে উপরে আরোপিত কর থেকে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ অসংখ্য কামান আর বন্দুক কেনার জন্য ব্যয় করেছে এবং অভিজ্ঞ অটোমান অস্ত্রনির্মাতাদের রাজি করিয়েছে তার ঢালাইখানায় কাজ করতে। প্রতিটা যুদ্ধে আমাদের পক্ষে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীর উপস্থিতিই যথেষ্ট এমন আত্মশ্লাঘা আমরা আর করতে পারি না। তাদের উপস্থিতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তার আগে আরো একবার আমাদের কৌশল পরিবর্তন করার সময় হয়েছে।
হ্যাঁ, তোমার বক্তব্য বিষয় সহজেই বোধগম্য হয়েছে, কিন্তু যুদ্ধের বাস্তবতায় এটা কিভাবে অর্থবহ হয়ে উঠবে? মাথার টিকি ধরে টানার অবসরে বাবা ইয়াসভালো জানতে চায়।
মহামান্য সম্রাটের আব্বাজান সম্রাট বাবর তাঁর জীবনের শেষ লড়াইগুলোতে যে কৌশল ব্যবহার করেছিলেন এর সাথে তার যৌবনে অনুসৃত কৌশলের সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে, সুলেইমান মির্জা উত্তর দেয়। অশ্বারোহী তীরন্দাজদের নিয়ে গঠিত হামলাকারী বাহিনীকে প্রথমে গুজরাটে পাঠান যেতে পারে বাহাদুর শাহের বাহিনীকে তাঁরা যেখানেই দেখতে পাবে সেখানেই তাঁদের আক্রমণ করবে এবং বাহাদুর শাহ তাঁদের বিরুদ্ধে নিজের সৈন্যদের সন্নিবেশিত করার অনেক আগেই তারা বাতাসে মিলিয়ে যাবে। আমাদের মূলবাহিনী কোথা থেকে আক্রমণ করবে সে বিষয়ে তাঁকে একটা বিভ্রান্তির ভিতরে ফেলে দিতে হবে এবং এই পুরোটা সময়ে আমরা রণহস্তি আর গোলন্দাজদের সমন্বয়ে গঠিত আমাদের মূল বাহিনী নিয়ে তাঁর ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে নিশ্চিত নির্ভরতার সাথে এগিয়ে যাব।
হুমায়ুনের অধিকাংশ উপদেষ্টাই যদিও মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে, কিন্তু বাবা ইয়াসভালো প্রশ্ন করেন, কিন্তু সেক্ষেত্রে আমাদের মূল বাহিনীর নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু কি হওয়া উচিত?
গুজরাটের গহীন জঙ্গলে অবস্থিত চম্পনির দূর্গ লক্ষ্যবস্তু হলে কেমন হয়? হুমায়ুন প্রস্তাব করেন। বাহাদুরের রাজকোষের একটা বিপুল অংশ এখানে রক্ষিত আছে। আমরা যদি এটা কুক্ষিগত করতে পারি সে বিষয়টা মেনে নিতে পারবে বলে মনে হয় না। আমাদের অবরোধকারী বাহিনীর কাছ থেকে একে মুক্ত করতে সে। বাধ্য হবে আক্রমণ করতে।
সেতো বুঝলাম, কিন্তু আমরা আমাদের অবরোধকারী বাহিনীর পেছনের হুমকি কিভাবে মোকাবেলা করবো? সুলেমান মির্জা জানতে চায়।
বাবা ইয়াসভালো এবার তার প্রশ্নের উত্তর দেয়, আসন্ন যুদ্ধের ভাবনায় তাঁর চোখ চকচক করছে। সময়ের বরাভয় আমাদের পক্ষে থাকবে। আমরা আমাদের কামানগুলো মাটি খুড়ে এমনভাবে স্থাপণ করতে পারি যাতে তাঁরা দূর্গ আর পেছন থেকে আগুয়ান বাহিনীর উপর একই সাথে গুলিবর্ষণ করতে পারে, এবং আমরা আমাদের সেনাবাহিনীকে এমনভাবে বিন্যস্ত করবো যাতে তাঁরা দুপাশেই যুদ্ধ করতে পারে। বাহাদুর শাহ যদি অবরোধ ভাঙা চেষ্টা করে তাহলে সে বিপজ্জনক এক চমকের সম্মুখীন হবে।
আপনার বক্তব্যের মাঝে কোনো খুঁত নেই, হুমায়ুন বলে। গুজরাতের সীমানা অতিক্রমকারী প্রথম হানাদার বাহিনীর নেতৃত্বে আমি নিজে থাকব। বাহাদুর শাহ যখন শুনবে- কথাটা নিশ্চয়ই তার কানে পৌঁছাবে- যে আমি নিজে লড়াইয়ের ময়দানে উপস্থিত আছি, আমাদের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে এটা তাকে আরও বেশী বিভ্রান্তির ভিতরে ফেলে দেবে। সুলেমান মির্জা, আমি বাবা ইয়াসভালো আর আপনার উপরে যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য সম্পূর্ণ নির্ভর করছি। আলোচনা আজ এই পর্যন্তই মূলতবী থাকল।
কথাটা বলেই হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায় এবং তাঁর দুই দেহরক্ষী আরও একবার তার সামনে অবস্থান নিয়ে আঙ্গিনার অপর প্রান্তে তার খাস কামরার দিকে ধীরে ধীরে তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে। সেখানে পৌঁছাবার পরে সে জওহরকে, তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত পরিচারক আর রাজ-অনুচর লম্বা, সুদর্শন চেহারার এক তরুণ যার বাবা বাবরের দেহরক্ষী বাহিনীর একজন অধিনায়ক ছিলেন পাঠায় তার ব্যক্তিগত জ্যোতিষীকে একঘন্টার ভিতরে তাঁর সামনে উপস্থিত হবার আদেশ দিয়ে যাতে তাঁর এই অভিযান শুরু করার সবচেয়ে মাঙ্গলিক সময় গণনা করা যায়। তাঁর যুদ্ধ পরিকল্পনা খুব দ্রুতই নির্ধারিত হয়। তাঁর আক্রমণ শুরু করার সময়ের প্রতি জ্যোতিষীর রাশিফল আর গণনার বরাভয় রয়েছে এই দৃঢ় আশ্বাস সম্রাট হিসাবে সে যখন তাঁর প্রথম অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে তখন তাঁর নিজের আত্মবিশ্বাস আর সেই সাথে তার বাহিনীর মনোবলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।