কিন্তু এখন যখন সেই মুহূর্ত প্রায় সমাগত, হুমায়ুন এক বিচিত্র অনীহা নিজের ভিতরে অনুভব করে। সে কি করবে সে বিষয়ে মাত্র আধঘন্টা আগেও সে ভীষণভাবে নিশ্চিত ছিল- তৈমূরসম নির্মমতায়, সে কোনো প্রকার কালক্ষেপন না করে কামরান আর আসকারির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেবে, আর হিন্দালকে প্রত্যন্ত কোনো দূর্গে আজীবনের জন্য নির্বাসনে পাঠাবে। কিন্তু তাঁদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে অবাধ্য আর উদ্ধত কামরান, আসকারি আর কিশোর হিন্দাল আক্ষরিক অর্থেই আতঙ্কিত- হুমায়ুন বুঝতে পারে তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হচ্ছে। মাত্র কয়েক মাস আগেই তাদের আব্বাজান ইন্তেকাল করেছে, আর তাছাড়া সে কিভাবে বাবরের অন্তিম ইচ্ছার কথা উপেক্ষা করবে? তোমার ভাইদের বিরুদ্ধে কখনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যেও না, সেটা তাঁদের প্রাপ্য বলে তোমার যতই মনে হোক। প্রেমিকসুলভ আচরণের ক্ষেত্রে আমরা যেমন করে থাকি, কখনও এমন সময় আসবে যখন কঠোর হতে হবে, আর কখনও হতে হবে সহৃদয়।
হুমায়ুন তার সিংহাসন থেকে নীচে নেমে এসে, ধীরে ধীরে তার শিকলাবদ্ধ ভাইদের দিকে হেঁটে যায়, এবং তাঁদের আলিঙ্গন করে, কামরানকে বাহুবন্দি করা দিয়ে বিষয়টা শুরু হয়। তাঁর সামনে মৃদু টলতে থাকা ত্রিমূর্তির চোখে মুখে বিভ্রান্ত অভিব্যক্তি, তার এহেন আচরণের মানে খুঁজতে তারা তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমরা ভাইয়েরা নিজেদের ভিতরে লড়াই করবো এটা ঠিক আমাদের শোভা দেয় না। আমাদের এই নতুন ভূখণ্ডের মাটিতে আমারই হাতে আমাদের বংশের কারো রক্ত ঝরুক এটা আমার কাম্য নয়। আমাদের রাজবংশের জন্য সেটা একটা অশুভ লক্ষণ বলে বিবেচিত হবে। আমার প্রতি তোমরা আনুগত্যের শপথ নাও আর তোমরা তাহলে প্রাণে বেঁচে যাবে। শাসন করার জন্য আমি তোমাদের প্রদেশও প্রদান করবো যা যদিও এই সাম্রাজ্যেরই অংশ, কিন্তু আমার কাছে জবাবদিহি করা ছাড়া, তোমরা স্বাধীনভাবেই শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারবে।
হুমায়ুন তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অমাত্যবর্গ আর সেনাপতিদের ভেতরে প্রথমে একটা বিস্ময়ের ধ্বনি শুনতে পায় এবং ধীরে ধীরে সেটা সম্মতির ব্যঞ্জনা লাভ করে, এবং গর্বে তার বুকটা ভরে উঠে। চুড়ান্ত মহত্ত্ব একেই বলে। এটাই একজন সত্যিকারের সম্রাটের আচরণ- শক্তহাতে সব মতপার্থক্যের বিনষ্টিসাধন কিন্তু তারপরেই মহানুভবতা প্রদর্শন করা। সে দ্বিতীয়বারের মতো যখন তাঁর ভাইদের আবার আলিঙ্গন করে, আসকারি আর হিন্দালের চোখে তখন কৃতজ্ঞতার অশ্রু চিকচিক করে। কিন্তু কামরানের সবুজাভ চোখ শুকনো থাকে, আর মুখাবয়বে বিষণ্ণ আর দুর্বোধ্য একটা অভিব্যক্তি।
১.২ এক নিলাজ দুশমন
০২. এক নিলাজ দুশমন
লাল বেলেপাথরে নির্মিত আগ্রা দূর্গের প্রাকার বেষ্টিত প্রাঙ্গনে অবস্থিত জলবুদ্বুদ নিঃসরণরত কৃত্রিম প্রস্রবনের পাশ দিয়ে উঁচু বলভিযুক্ত দরবার হলের দিকে যাবার পথে হুমায়ুনের আগে আগে হেঁটে যাওয়া লম্বা আর সাদা পাগড়ি পরিহিত দুই দেহরক্ষীর বুকের বর্মে সকালের সূর্যের আলো সোনার দ্যোতনা তুলে চিকচিক করে। স্তম্ভযুক্ত দরবার কক্ষের, শীতল বাতাসের অবারিত প্রবাহের জন্য যার তিন দিকই উন্মুক্ত, ভিতর দিয়ে আর সমবেত উপদেষ্টামণ্ডলীর কাতারের মাঝে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে, যারা তার অগ্রসর হবার সাথে সাথে প্রথাগত অভিবাদন জানাবার রীতিতে নিজেদের আনত করে, হুমায়ুন কক্ষের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত মার্বেলের বেদীতে আরোহণ করে। সেখানে, পরণের সবুজ রেশমের আলখাল্লাটা সামলে নিয়ে সে তার সোনার পাত দিয়ে গিলটি করা, উঁচু পৃষ্ঠদেশযুক্ত সিংহাসনে নিজেকে উপবিষ্ট করে। তার সাথে আগত দুই দেহরক্ষী তরবারির বাটে হাত রেখে সিংহাসনের ঠিক পেছনে, দুই পাশে অবস্থান গ্রহণ করে।
হুমায়ুন ইঙ্গিতে তার উপদেষ্টাদের এবার উঠে দাঁড়াতে বলে। তোমরা জান কেন আজ আমি তোমাদের একসাথে এখানে ডেকে এনেছি- সুলতান বাহাদুর শাহের প্রভৃষ্ট ঠাট-ঠমকের বিষয়ে আলোচনা করতে। আমাদের রাজ্যের দক্ষিণপশ্চিমে গুজরাটের সমৃদ্ধ অঞ্চল নিয়ে সে সন্তুষ্ট থাকতে পারছে না, দিল্লীর পরাভূত সুলতান, ইব্রাহিম লোদি যাকে আমি আর আমার মরহুম আব্বাজান তোমাদের চমকপ্রদ সহায়তার দ্বারা সিংহাসনচ্যুত করেছিলাম, তার সন্তানদের সে। শরণ দিয়েছে। তাঁদের সাথে নিজের পারিবারিক বন্ধনের কথা ঘোষণা করে, নিজের চারপাশে মিত্র সংগ্রহ শুরু করেছে সে। রাজপুত আর আফগান গোত্রগুলিকে তার দূতেরা সুকৌশলে বোঝাতে চাইছে যে আমাদের সাম্রাজ্যের ভিত্তি বাস্তবের চাইতে কল্পনার মানসপটে বেশী প্রোথিত। আমাদের সাম্রাজ্য মাত্র দুইশ মাইল প্রশস্ত হবার কারণে সে বিষয়টা নিয়ে ঠাট্টা উপহাস করছে যদিও খাইবার গিরিপথ থেকে এটা হাজার মাইলের বেশী প্রসারিত। বর্বর হানাদার তকমা দিয়ে তারা আমাদের একেবারে খারিজ করে দিতে চাইছে ভোরের শিশিরের মতো সহজেই যাদের শাসনক্ষমতা থেকে উৎখাত করা যাবে।
আমরা তাদের এই মনোভাব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং আমাদের ঘৃণারও অযোগ্য বলে বিবেচনা করি কিন্তু আজ সকালে এক বার্তাবাহক- সারারাত ঘোড়া দাবড়ে আসবার কারণে পরিশ্রান্ত- খবর নিয়ে এসেছে যে বাহাদুর শাহের একদল সৈন্য, যার নেতৃত্বে ছিল লোদি রাজ্যাভিযোগী তার্তার খান, আমাদের ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে হামলা করেছে। আগ্রা থেকে মাত্র আশি মাইল পশ্চিমে, আমাদের অনুগত এক রাজপুত জায়গিরদারের প্রেরিত উপহারসামগ্রী বহনকারী কাফেলা তারা দখল করেছে। আমি নিশ্চিতভাবে এখন কেবল এটুকুই বলতে পারছি। আমরা কদাপি এমন অসম্মান সহ্য করবো না। আমাদের উচিত এবং অবশ্যই আমরা সুলতানকে এজন্য সমুচিত শিক্ষা দেব। আমাদের উচিত তাঁকে পরাস্ত করা কিনা সে বিষয়ে আলোচনার জন্য আমি আজ তোমাদের এখানে আসতে বলিনি, আমি তোমাদের ডেকেছি কিভাবে সেটা সবচেয়ে ভালোভাবে করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা করতে। হুমায়ুন দম নেয়ার জন্য কথা বন্ধ করে এবং পুনরায় শুরু করার আগে চারপাশে নিজের উপদেষ্টাদের দিকে ভালো করে তাকায়।