তাঁর বোন কয়েক পা সামনে এগিয়ে ধীরে ধীরে মাথার ঘোমটা নামিয়ে দিলেন। শেষ যখন আওরঙ্গজেব তাঁকে দেখেছিলেন, তারপর এই সাত বছরে তার বয়স বেশ বেড়ে গেছে মনে হল। তাঁর একান্ন বছর বয়স থেকেও তাকে আরো বয়স্ক মনে হচ্ছিল। মোটা বেনি করা চুল প্রায় সাদা হয়ে গেছে আর চিবুক চামড়া থেকে ঠেলে উঠেছে। বাম গালে আর গলায় এখনও আগুনে পোড়ার দাগগুলো রয়েছে। অল্পবয়সে সেই আগুনে তিনি প্রায় পুড়ে মরছিলেন। চোখের নিচে কালি। আওরঙ্গজেব কি বলবেন, তা মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন, কিন্তু তার এই জীর্ণশীর্ণ মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে তাঁর মুখ থেকে কোনো কথা বের হল না। তাঁকে ইতস্তত করতে দেখে জাহানারা আরো কাছে এগিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে একজন সম্রাটের উপযুক্ত সম্মান দেখাতে শুরু করলেন।
আওরঙ্গজেব তাঁকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, না? তিনি বাধা দিলেন না, আর যখন তাঁকে ছাড়লেন তখন আওরঙ্গজেব দেখলেন তার চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। আর এটা দেখে তাঁর নিজের চোখের পাতাও খচখচ করে উঠলো, তিনি বহু কষ্টে তা সামলিয়ে বললেন, এখানে এসে আমার পাশে বসুন। অনেকদিন হল আপনি আমার পাশে বসেন না। তাঁকে আবেগে ভেসে গেলে চলবে না। জাহানারা স্বেচ্ছায় তার বাবার সাথে কারাবরণ বেছে নিয়েছিলেন, অথচ তিনি এখানে ম্রাজ্ঞী হতে পারতেন। আর তার চেয়ে বেশি খারেজি দারাকে ভালোবাসতেন… আর এই কথাটাই তার সবসময় মনে পড়তো, যখনই তিনি জাহানারার কথা ভাবতেন। আর এটাই তাকে শক্তি যোগাতো এই কথাটি ভুলে যেতে যে, যতকিছুই হোক তার বড় বোন তাঁর কাছে মায়ের মতো ছিলেন আর তিনি সব ব্যাপারে তার সম্মতি চাইতে পারতেন।
জাহানারা মৃদুকণ্ঠে বললেন, আমি খুশি যে, শেষ পর্যন্ত আমাদের বাবা, আমাদের মায়ের পাশেই শান্তিতে শুয়ে রয়েছেন। যা যা করার দরকার সবকিছুই আমি করেছি–মোল্লারা সারাদিনরাত তাঁর আত্মার শান্তির জন্য মঙ্গল কামনা করে দোয়া করেছেন।
ধন্যবাদ।
শেষ মুহূর্তে তিনি আমাকে বলেছিলেন, যে তোমার বিরুদ্ধে তাঁর কোনো অভিযোগ নেই… তিনি তোমাকে ক্ষমা করেছেন।
একথাটি শোনার পর আওরঙ্গজেব সমুচিত জবাব দিয়ে বলতে চাচ্ছিলেন : কি জন্য তিনি আমাকে ক্ষমা করবেন? তাঁর অযোগ্য হাত থেকে সাম্রাজ্য রক্ষা করার জন্য আর আমার ধর্মভ্রষ্ট ভাইয়ের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য, যিনি এটা ধ্বংস করে দিতেন? আমি তাঁকে ক্ষমা করি নি…তিনি কখনও আমার কাজের প্রশংসা করেন নি।
কিন্তু তিনি এই কথাগুলো উচ্চারণ না করে বরং জিজ্ঞেস করলেন, আর কিছু বলেছেন?
তিনি আমাকে বলেছেন, আমি যেন তোমাকে অনুরোধ করি, যেকোনো উপায়েই হোক তুমি যেন তোমার ছেলেদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখো আর ছেলেদেরকে পরস্পরের সাথে লড়াই করতে অনুমতি দিও না। তিনি তখত ইয়া তক্তা–সিংহাসন কিংবা শবাধার–একজন যোদ্ধার এই গোপন নীতিমালা বা সংকেত লিপির কথা বলেছেন, যা আমরা তৃণভূমিতে আমাদের পুরোনো দেশ থেকে নিয়ে এসেছি। তিনি বলেছেন যখন আমরা হিন্দুস্তানে প্রবেশ করেছি তখন থেকেই এটা আমাদের বংশের বিপর্যয়ের হেতু হয়ে দাঁড়িয়েছে। একেবারে শেষ নিশ্বাস নেওয়ার সময় তিনি ফিসফিস করে আমাকে বললেন যে, আমাদের রাজবংশের সবচেয়ে বড় হুমকিটা সবসময় ভেতর থেকে এসেছে। যদি আমরা সাবধান না হই, তাহলে আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংস করবো আর আমাদের শত্রুদের কিছুই করতে হবে না, ওরা কেবল আমাদের একদা বিশাল সাম্রাজ্য থেকে লুটের ভাগ নিয়ে যাবে। তিনি বললেন, তিনি চেষ্টা করেছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা থামাতে, তবে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি কি শুধু এ বিষয় নিয়েই নিজেকে ভর্ৎসনা করেছেন?
না। তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, জীবনে তিনি ভুল করেছেন…অবশ্য আমরা সবাই তাই করি।
আওরঙ্গজেব অনুভব করলেন জাহানারা তাঁর দুহাতের মাঝে তার হাতটা ধরেছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি মনে হয়, আমি যা করেছি তা ভুল ছিল?
তুমি জানো আমি তাই মনে করি। একজন পুত্র এবং একজন ভাই হিসেবে তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করনি। তুমি দারাকে তোমার শত্রু বানিয়েছ, মিত্র বানাও নি। তারপর যখন তাঁকে পরাজিত করলে, তখন তাঁকে আর তাঁর ছেলেকে মেরে ফেলার দরকার ছিল না। কিংবা অন্য ভাইদের বিরুদ্ধে না গেলেও পারতে। কথাগুলো বলার সময় তিনি হয়তো অনুভব করতে পারছিলেন যে, তাঁর দুহাতের মধ্যে আওরঙ্গজেবের হাতটি শক্ত হয়ে গেছে, তাই তিনি আরো জোরে তার হাতটা চেপে ধরে বললেন, কিন্তু আওরঙ্গজেব, যা হবার হয়েছে। যে বাবার সাথে তুমি এত অন্যায় করেছে, তিনি যদি তোমাকে ক্ষমা করতে পারেন, আমারও তা করা উচিত। আমরাতো এখনও ভাই আর বোন, তাই না? তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কখনও কমে যায় নি। যদিও আমি বাবার সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি এটা করেছি, কেননা আমি মনে করেছিলাম এটাই আমার জন্য ঠিক–একজন কন্যা হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব ছিল।
আওরঙ্গজেব তার মাথা এমনভাবে নিচু করলেন, যাতে জাহানারা তাঁর মুখটা দেখতে না পারেন। যে বোনকে তিনি সবসময় ভালোবাসতেন, তার সাথে আবার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ফিরে পেয়ে তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললেন, আপনি এখুনি আমার সাথে দিল্লিতে আমার দরবারে চলুন। আমাদের মায়ের মৃত্যুর পর বাবা যেমন আপনাকে সম্রাজ্ঞী করেছিলেন, এখন আপনি আবার এই সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হবেন। আমি আপনাকে পাদিশাহ বেগম–শাহজাদিদের রানি করবো। ইচ্ছে করলে আপনি আপনার নিজের জন্য আলাদা মহল…দাসিচাকর… আমার ধনভাণ্ডারের সর্বশ্রেষ্ঠ রত্ন, সব নিতে পারেন।