মমতাজের মৃদু হাসির কথা মনে পড়তেই আওরঙ্গজেব ভ্রু কুঁচকালেন। তার স্মৃতি ছিল অম্ল-মধুর। তাজমহল থেকে মাত্র আসার পর এখন তা আরো বেশি মনে পড়ছে, যেখানে এখন তাঁর বাবা তাঁর মায়ের পাশে শুয়ে রয়েছেন। সমাধির পাশে বসে তিনি একা কেঁদেছিলেন, সেটা কি মমতাজের জন্য এবং তাঁর মৃত্যুর পর তিনি যে একাকীত্বে ভুগছেন সে জন্য, নাকি শাহজাহানের জন্য অথবা তার নিজের জন্য, তা নিশ্চিত নয়।
আওরঙ্গজেব চিবুক তুললেন। কেউ যেন তার চেহারায় একজন সম্রাটের উপযুক্ত গাম্ভীর্য ছাড়া আর কিছুই না দেখতে পায়, যিনি তাঁর বাবার মৃত্যুতে শোক পালন করছেন। চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন, সবকিছু ঠিকঠাক আছে। যেরকম তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন; যখন একজন বার্তাবাহক মুয়াজ্জমের কাছ থেকে খবর নিয়ে এসেছিল যে, সে আগ্রা পৌঁছে দেখে শাহজাহান ইতিমধ্যেই মারা গেছেন। দুর্গের উপরে সবুজের জায়গায় সাদা পতাকা উড়ছে। ফোয়ারাগুলো স্ত ব্ধ। এমনকি গোলাপঝাড় থেকে সমস্ত ফোঁটাফুল কেটে ফেলা হয়েছে। কেউ যেন বলতে না পারে যে, তিনি তাঁর বাবার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা দেখান নি, যিনি শুধু তাঁর বাবাই নন, তিনি এককালে মোগল সম্রাটও ছিলেন।
বহু স্তম্ভ শোভিত দেওয়ান-ই-আমে পৌঁছার পর তিনি ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলেন। সেখানে সাদা পোশাক পরা সভাসদ ও সেনাপতির একটি দল নীরবে তাঁকে অভ্যর্থনা করার জন্য অপেক্ষা করছিল। ঘোড়া থেকে নেমে তিনি ডানে-বাঁয়ে তাকাতে তাকাতে অপেক্ষমাণ দলটির সারির মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে চললেন। ওরা সবাই বুকে ডানহাত রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে তাঁর প্রতি আনুগত্য ও বাধ্যতা প্রকাশ করছিল। মার্বেল পাথরের মঞ্চের কাছে পৌঁছে আওরঙ্গজেব ধীরে ধীরে সিঁড়ির তিনটি ধাপ বেয়ে মঞ্চে উঠে ঘুরে তাকালেন। আওরঙ্গজেব দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগে এই মঞ্চেই ময়ূর সিংহাসনটি ছিল। তিনি দুই হাত তুলে শুধু বললেন, আজকের এই বিষাদময় দিনে আমার কাছে, আপনাদের সম্রাটের কাছে আসার জন্য আমি আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আজ রাতে যখন আপনারা প্রার্থনা করবেন, আমি অনুরোধ করবো তখন এই কথাটি মনে রাখবেন, যেরকম আমিও স্মরণ করবো যে, এই পার্থিব জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং আমরা এখন যেরকম আছি তার জন্য সবাই মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ এবং আমরা যে অবস্থানেই থাকি না কেন, সকলকে তাঁর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তারপর আওরঙ্গজেব পেছন ফিরতেই একজন ভৃত্য–কোরচি দরজা মেলে ধরতেই তিনি ভেতরে খাসমহলের দিকে এগিয়ে চললেন।
বার্নিশ করা চকচকে সোনালি শামিয়ানার নিচে সাদা মার্বেল পাথরের কামরাটি ম্লান আলোয় মৃদু দীপ্তি ছড়াচ্ছে। একটি মুহূর্ত তার মনে হল যেন, তাঁর মায়ের সুন্দর মূর্তিটি একটি ধনুকাকৃতি খিলানের নিচে দাঁড়িয়ে তার স্বামী আর সন্তানদের জন্য অপেক্ষা করছেন, যেন সবাই একসাথে নৈশ আহার করতে পারেন।
তারপর তিনি কামরায় ঢুকে তার জন্য পেতে রাখা একটি নিচু, নরম আসনে বসে একটি রেশমি বালিশে হেলান দিলেন। দেয়ালে আয়না বসানো কুলুঙ্গিতে মোমবাতির শিখা কেঁপে কেঁপে উঠছে। খানসামারা তাঁর সামনে একটি সাদা কাপড় বিছিয়ে তার উপর খাবারের থালা সাজিয়ে রাখতে শুরু করলো। ভোর থেকে তিনি কিছুই খান নি, তারপরও তার মোটেই খিদে পায় নি। কেবল সামান্য সাদা ভাত, ডাল আর তন্দুরি থেকে মুরগির মাংস নিলেন। তারপর যমুনা থেকে আনা বরফ-শীতল পানি খেলেন। কোরচি তাঁর নিজস্ব পেয়ালায় পানি ঢেলে দিল। এই পেয়ালাটি তিনি যেখানে যান সেখানেই তাঁর কোরচি সাথে বয়ে নিয়ে যায়। আলোকভেদ্য কিন্তু অস্বচ্ছ একটি জেড পাথর কেটে গোলাপের আকৃতি দেওয়া হয়েছিল। পানিতে বিষ থাকলে সাথে সাথে এটি বিবর্ণ হয়ে যাবে।
খাওয়া শেষ করে আওরঙ্গজেব বেলকনিতে গেলেন। যমুনা নদীর বাঁকের উপরে পূর্ণিমার চাঁদ উঠছে। তাজমহলের মুক্তার মতো গম্বুজ রূপালি আলোয় ভরে গেল। কয়েকমুহূর্ত আওরঙ্গজেব এই দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে রইলেন… ভাষায় বর্ণনা করা যায় না এমন একটি বিষণ্ণ অথচ অপরূপ দৃশ্য। তারপর পেছন ফিরলেন। এখন তিনি সাক্ষাৎকারটি করতে চাচ্ছেন তা আর দেরি করা যায় না আবার তার ভীষণ ভয়ও করছিল। একবার হাততালি দিলেন।
মসলিনের পর্দা সরিয়ে কোরচি বেলকনিতে ঢুকে বললো, জাঁহাপনা?
আমার বোন শাহজাদি জাহানারার কাছে যাও। আমার তরফ থেকে সালাম। জানিয়ে তাকে এখানে আসতে বল।
অপেক্ষা করতে করতে আওরঙ্গজেব বেলকনিতে পায়চারি করতে লাগলেন আর সেই সাথে তার লম্বা আঙুল দিয়ে সবুজ জেড পাথরের তসবিহ জপ করতে লাগলেন। এটা সবসময় তাঁর কোমরবন্ধ থেকে ঝুলে থাকে। সেই সাথে তাঁর বুকও ঢিপঢিপ করছিল যেন এখুনি কোনো যুদ্ধে ছুটবেন। একটুপরই পেছনে মানুষের পায়ের শব্দ শোনা গেল আর কোরচি বলে উঠলো, জাঁহাপনা, তিনি এসেছেন।
ঠিক আছে। তুমি এখন যাও আর দ্যাখো কেউ যেন আমাদের বিরক্ত না করে।
তিনি ঘুরে দেখলেন সাদা মসলিন পোশাক পরা শীর্ণ একটি মূর্তি, মাথা সাদা শালের ঘোমটায় ঢাকা, ছায়ায় মুখ দেখা যাচ্ছে না। ভাই, বোন, একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর আওরঙ্গজেব নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন, আপনি কেমন আছেন জাহানারা? একটু কাছে আসুন আপনাকে দেখি।