আওরঙ্গজেব ধীরে ধীরে তাঁর বোনের হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন, জানি না।
তিনি বুঝতে পারলেন তাঁকে এখন সাবধানে ভাবতে হবে। তাঁর বাবার অসুস্থতার খবরটি অপ্রত্যাশিত নয়। আর তা হবেই বা কেন? শাহজাহান বৃদ্ধ হয়েছেন, আর কারাধ্যক্ষ নিয়মিত তাকে যে খবর জানাতো, তাতে বোঝা যাচ্ছিল সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তিনি আরো দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। যদি আওরঙ্গজেব সম্ভবে চিন্তা করেন আর নিজের মনের সত্যিকার অনুভূতি নিজের কাছে না লুকান, তাহলে এটা ঠিক যে, সেই যখন তিনি তার বাবাকে সিংহাসনচ্যুত করে তাকে বন্দী করেছিলেন, তখন থেকেই গত ছয় বছরে তিনি বেশ কয়েকবার তাঁর বাবার মৃত্যু কামনা করেছিলেন। অন্তত আন্তরিকভাবে এটাও ভাবতেন যে….
কিন্তু এখন যেহেতু তাঁর বাবার শেষ সময় আসলেই ঘনিয়ে এসেছে, তখন তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না কি করবেন। রওশনআরাকে যাই বলুন না কেন, শাহজাহানকে বন্দী করে তিনি কি একটু অপরাধ বোধ করছেন না? কেন একবারও তাকে দেখতে কারাগারে যাননি? এটা কি এ কারণে যে, তিনি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, যদি তাঁর বাবা তাকে ক্ষমা করে দেন, তার প্রতি ভালোবাসা দেখান আর এতে বাবার প্রতি তাঁর মন নরম হয়ে যায়? কিন্তু দুজনে মিটমাট করে ফেললে তার পরিণতিটা কি হবে? শাহজাহান আবার সিংহাসনে ফিরে আসবেন নাকি তার ভাই দারা শিকোর জীবিত পুত্র বসবে? না, সাম্রাজ্যের স্বার্থে এটা কখনও তিনি হতে দেবেন না। কিংবা এটা হয়তো অন্যকিছু : তার ভয় হচ্ছে শাহজাহানের চোখে না জানি কি দেখতে পাবেন। শুধু ঘৃণাই দেখতে পাবেন, ভালোবাসা নয়, যা তিনি ছোটবেলায় একজন পিতার কাছ থেকে আশা করতেন। অথচ তার বাবা তার সমস্ত ভালোবাসা তার খারেজি জ্যেষ্ঠ পুত্রের জন্য সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন।
এমনকি যখন তিনি দিল্লি থেকে বজরায় যমুনা নদীর উপর দিয়ে তাজমহলে যেতেন প্রার্থনা করতে, যেখানে রত্নখচিত সাদা মার্বেল পাথরের কবরে তার মা শুয়ে আছেন, তখনও তিনি একবারও চোখ তুলে আগ্রা দুর্গের দিকে তাকাননি। দুর্গের লাল বেলেপাথরের দেয়ালের ছায়ার নিচ দিয়ে যাওয়ার সময়, সচেতন হয়ে ভাবতেন যে, শাহজাহান হয়তো দুর্গের প্রকারবেষ্টিত সমতল ছাদের উপরে তাঁর কারাগারের অষ্টকোণ টাওয়ারের ভেতর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। এমন একটি মাস যায়নি যে, শাহজাহান তাকে চিঠি লিখে আদেশ করেছেন কিংবা অনেক সময় মিনতিও করেছেন অন্তত একবারও তাকে দেখতে যেতে। কিন্তু তিনি নিজেকে সংযত রেখেছেন, কোনো উত্তর দেননি। দুই-একদিন এই বিষয়টি নিয়ে একবারও ভাবার চেষ্টা করেননি। তিনি নিজেকে বুঝাতেন এই চিঠিগুলো একধরনের ফন্দি, যাতে তিনি নিজেকে অপরাধী ভাবেন। তাঁকে দেখার জন্য বাবার মোটেই কোনো আকুলতা নেই।
সুতরাং তিনি কোনোদিন তার বাবাকে দেখতে যাননি। আর একজন সন্তান হিসেবে এখন করুণা দেখাবার জন্যইবা কেন যাবেন? আর বাবার মৃত্যুশয্যায় এখন উপস্থিত হলে কি উদ্দেশ্য সাধন হবে? শুধু আবার জেগে উঠবে সন্দেহের অনুভূতি, কিংবা হয়তো অপরাধ বোধ, যা ইতিমধ্যেই তার মনে জেগে উঠছে আর সেই সাথে সম্ভবত সত্যিকার দুঃখ বোধ। একটু আগেই অতিরিক্ত ভাবাবেগ সম্পর্কে রওশনআরাকে কি সাবধান করেননি? স্বভাব সুলভভাবে চোখ বুজে চিন্তা করার পর তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস নিলেন। মনে হয় উপায় একটা খুঁজে পাওয়া গেছে।
শাহজাদা মুয়াজ্জমকে একটা চিঠি লেখো। সে আগ্রা থেকে কেবল বিশ মাইল দূরে শিবির স্থাপন করেছে। তাকে বলো ঘোড়ায় চড়ে দুর্গে যেতে, সেখানে গিয়ে পিতামহকে দেখার পর ফিরে এসে আমাকে জানাবে তিনি কেমন আছেন। আমার ছেলেকে সেখানে পাঠিয়ে আমি আমার বাবার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা দুটোই প্রদর্শন করবো। আর এই ফাঁকে একটু চিন্তা করার সুযোগ পাবো যে, সেখানে আমি নিজে যাবো কি যাবো না।
আওরঙ্গজেব যে তার উপর আস্থা রেখেছেন এই কথাটি ভেবে রওশনআরা কৃতজ্ঞ বোধ করলেন। তিনি সাথে সাথে বললেন, এখনই লিখছি। এই কথাটি বলে তার খাড়া রেশমি ঘাগড়ার খসখস শব্দ করে ঘুরে চলে গেলেন।
একা হওয়ার পর আওরঙ্গজেব আবার কুরআন শরিফ তুলে নিলেন। পাতা খুলে সূরার দিকে তাকালেও পবিত্র আয়াতের দিকে মনোযোগ দিতে পারলেন না। পিতার সাথে দেখা করার সিদ্ধান্তটি আপাতত স্থগিত করার কারণে মনে হয় তাঁকে আর হয়তো জীবিত দেখতে পারবেন না। আর সেই সাথে একটি মুখোমুখি অবস্থা এড়াতে পেরেছেন, যেখানে তিনি হয়তো তাঁর আবেগ সামলাতে পারতেন না, পরিণতি তো দূরের কথা। একমুহূর্তের জন্য চোখ বুজতেই অন্ধকারের বদলে পরিষ্কার তাঁর সবচেয়ে বড় বোন জাহানারার মুখটা দেখতে পেলেন, যেন তিনি এখানেই ছিলেন। জাহানারা তাঁর বাবার সাথে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেছিলেন আর তাই তার বিদ্রোহের সময় থেকেই আওরঙ্গজেব তাঁর বড় বোনকে দেখতে পারেননি। এখন তার মনের অবস্থা কি কে জানে আর তাঁকেই বা কিভাবে তিনি বিচার করবেন?
*
তিন সপ্তাহ পর শোকের শাদা পোশাক পরে আওরঙ্গজেব ঘোড়ায় চড়ে ধীরে ধীরে বাঁকা ঢাল বেয়ে উপরের দিকে উঠে তীক্ষ্ণ কীলক বসানো আগ্রা দুর্গের বিশাল প্রথম ফটকের ভেতর দিয়ে এগোলেন। শেষ যখন তিনি এখানে এসেছিলেন, তারপর অনেক বছর পার হয়ে গেছে, তারপরও সবকিছু চেনা মনে হচ্ছে। লাল বেলেপাথরের দুর্গ, উঠান আর বাগান সবকিছু সেই আগের মতোই আছে। সিংহাসনে বসার পর যখন তাঁর বাবা নতুন পরিবার নিয়ে এখানে বসবাস করতেন ঠিক তখনকার মতো। ঐ থামগুলোর মাঝে আওরঙ্গজেব তার ভাইদের সাথে তরোয়াল নিয়ে খেলতেন…আর তাঁদের অপরূপ সুন্দর প্রিয় মা গোলাপ সুরভিত কামরায় বসে সারাক্ষণ তাঁদের জন্য অপেক্ষা করতেন…?