আপনারা, মোগলরা মনে করেন আপনারা কুশলী যোদ্ধা। কিন্তু আপনাদের সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধারাও আমার দেশে বেশিদিন টিকতে পারে নি। মারাঠিদের ভূমি রুক্ষ আর কঠিন হলেও তা আমাদের। আমরা আমাদের দেশকে ভালোবাসি আর শেষ মানুষটি আর দুর্গগুলো থাকতে তা রক্ষা করবো। এখানে অনুপ্রবেশ করলে আপনারা নিজেদের রক্তের সাগরে ডুবে যাবেন।
অন্য কেউ হলে এধরনের দাম্ভিকতাপূর্ণ আর ঔদ্ধত্য মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে ঝোঁকের মাথায় হঠকারী কিছু একটা করে বসতো। নিঃসন্দেহে শিবাজিও আওরঙ্গজেব সম্পর্কে তাই ভেবেছিলেন। তবে অভিজ্ঞতা আওরঙ্গজেবকে আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখার মূল্য আর এখন কি করা দরকার সেদিকে মনোযোগ দিতে শিখিয়েছে। এক্ষেত্রে যারা প্রকাশ্যে তাঁর বিরোধিতা করার স্পর্ধা দেখিয়েছে, তাদেরকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। এটা তিনি নিজস্ব পদ্ধতিতে যথাসময়েই করবেন। তবে বিজয় যখন আসবে, তখন তা হবে পরিপূর্ণ ও চিরকালের জন্য, যা হঠাৎ গজিয়ে উঠা উচ্চাভিলাষী যে কোনো বিদ্রোহীর জন্য একটি শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকবে।
০২. বেগম পাদিশাহ
রুপা আর ফিরোজা দিয়ে বাঁধানো কুরআনটি নামিয়ে রেখে রওশনআরার দিকে তাকিয়ে আওরঙ্গজেব বললেন, কি ব্যাপার বোন? রওশনআরা তখনও হাঁপাচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল যেন তিনি ছুটতে ছুটতে হেরেম থেকে আওরঙ্গজেবের খাসকামরায় এসেছেন কোনোমতে কেবল এতটুকু বলতে পারলেন, দুজন কাসিদ-বার্তাবাহক–আগ্রা থেকে এসেছে। ওরা জাহানারার কাছ থেকে আমার জন্য একটি বার্তা নিয়ে এসেছে।
জাহানারা? উনি তো অসুস্থ ছিলেন, তাই না?
না…জাহানারা নন, আমাদের বাবা অসুস্থ। তিনি জানিয়েছেন, বাবা এখন মৃত্যুশয্যায়। তিনি অনুরোধ করেছেন, আমি যেন তোমাকে রাজি করিয়ে তার কাছে নিয়ে যাই। বাবা তোমাকে কিছু বলতে চাচ্ছেন।
আওরঙ্গজেব উঠে দাঁড়ালেন, কি বলবেন?
জাহানারা কিছু বলেন নি, তবে বেশ জোর দিয়ে এটা জানিয়েছেন তুমি যদি এখুনি না যাও তাহলে খুব দেরি হয়ে যাবে।
দেরি হবে, কার জন্য? আমার না বাবার?
রওশনআরা চোখ পিটপিট করলেন। অনেকসময় আওরঙ্গজেবের মন বোঝা খুব কঠিন হয়। তারপর সাহস করে বললেন, হয়তো তোমাদের দুজনের জন্য।
তিনি বহুদিন আগে আমার শ্রদ্ধা হারিয়েছেন। তাছাড়া এখন আমরা একজন আরেকজনের সাথে কি কথা বলবো? তিনি আমাকে ভর্ৎসনা করবেন। আর আমি তাকে বলবো, আমি যা করেছি তা সাম্রাজ্যের ভালোর জন্য করেছি। এতে আমাদের দুজনের কি লাভ হবে?
রওশনআরার চোখে পানি এল। তার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, আওরঙ্গজেব তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরবেন, কিন্তু তা হবার নয়। মুখ স্থির করে তিনি সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তার মুখ দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই। রওশনআরা বললেন, তোমার মনে আছে যখন আমি একেবারে ছোট ছিলাম তখন বাবা আমাকে একবার কিভাবে নদী থেকে উদ্ধার করেছিলেন? আমার অবশ্য এঘটনার কিছুই মনে নেই। অবশ্য তখন তো আমি খুব ছোট ছিলাম– জাহানারার কিন্তু ঠিক মনে আছে। যখন আমরা বড় হচ্ছিলাম তখন তিনি আমাকে প্রায়ই বলতেন কিভাবে আমাদের ঘোড়ার গাড়িটা উল্টে পানিতে পড়তেই আমি মায়ের হাত থেকে ছিটকে পানিতে পড়ে গিয়ে প্রায় ভেসে যাচ্ছিলাম, কিন্তু বাবা আমাকে উদ্ধার করেন। শুধু তার কারণেই আজ আমি বেঁচে আছি।
এই কাহিনী আমি বহুবার শুনেছি। আর যখন আমাদের মা বেঁচে ছিলেন, তখনকার সময়ের বাবার অনেক স্মৃতি আমার নিজেরও মনে আছে। তবে আমরা দুজনেই জানি মা মারা যাবার পরের বছরগুলোতে সবকিছু কিরকম বদলে গিয়েছিল। আমাদের বেশি আবেগপ্রবণ হওয়া উচিত নয়। বিশেষত একজন সম্রাট হিসেবে আমি চাই না কোনো ধরনের আবেগ আমার বিচারবুদ্ধিকে ঘোলা করে দিক।
তবে অনেকসময় আমার কি মনে হয় জানো, আমরা হয়তো সঠিকভাবে তাঁকে বিচার করতে পারিনি। মনে হয় তিনি আমাদের জন্য যা ভালো ভেবেছিলেন, তাই করছিলেন।
আওরঙ্গজেব তার বোনের দুহাত ধরে বললেন, এটা খুবই স্বাভাবিক যে এরকম একটি মুহূর্তে আমরা সেই বন্ধনের কথা ভাবি, যা আমাদেরকে পরিবারকে একসাথে বেঁধে রেখেছিল। তবে আমরা নিজেদের সাথেই প্রতারণা করবো, যদি আমরা ভাবি যে, আমরা যা করেছি তা ভুল ছিল। তাছাড়া কি করতে হবে সে সিদ্ধান্ত তুমি নাওনি। সেটা আমার নিজের ভালোর জন্য কিংবা সুবিধার জন্য ছিল না, সেটা করা হয়েছিল সাম্রাজ্যের স্বার্থে। দুনিয়া এবং আল্লাহর সামনে এর সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমি নিজে নিয়েছি। তোমার মনে রাখা উচিত, তখন আমি যদি সাথে সাথে কিছু না করতাম, তাহলে কি হতে পারতো? দারা শিকোহ শুধু খারেজি ছিলেন না, তিনি তাঁর ভাইদেরকে ঘৃণা করতেন। তিনি খুব দুর্বল চিত্তের মানুষ ছিলেন। যার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষরা লড়াই করেছিলেন, হাতে সময় পেলে তিনি তার অধিকাংশই ধ্বংস করে ফেলতেন। আর এদিকে আমাদের বাবার তাঁর প্রিয়পুত্রের কোনো দোষই চোখে পড়ে না। যেন একজন মানুষ ভরদুপুরের সূর্যের দিকে খোশমেজাজে তাকিয়ে রয়েছেন।
রওশনআরা মাথা নাড়লেন। তাঁর ভাই হয়তো ঠিকই বলেছেন–সাধারণত তিনি তাই বলেন। সেই যখন থেকে শাহজাহানের হাত থেকে সিংহাসন ছিনিয়ে নিয়ে আওরঙ্গজেব তার বড় বোন জাহানারার জায়গায় তাকে সাম্রাজ্যের প্রধান সম্রাজ্ঞী করেছিলেন, তারপর এতোবছর ওরা এসব বিষয় নিয়ে কখনও কোনো কথা বলেন নি। আর তিনি এতেই সন্তুষ্ট ছিলেন। মসৃণগতিতে আর বেশ আনন্দে তাঁর জীবন কেটে যাচ্ছিল, পদবি, সম্পদ…এদুনিয়ার জীবনে যা তিনি চেয়েছেন তার অধিকাংশ এখন তাঁর হয়েছে। তিনি হেরেম শাসন করেন। যদিও মাঝে মাঝে এমনভাবে নিজের ইচ্ছাপূরণ করেন, যা তিনি জানেন তার ভাই অনুমোদন করবেন না, তবে এসব বিষয়ে তিনি খুবই সতর্ক থাকেন। তিনি একজন ভালো সম্রাজ্ঞী ছিলেন, ঠিক যেরকম একজন ভালো কন্যাও ছিলেন। তারপর একসময় বুঝতে পারলেন দারা শিকোহ এবং জাহানারার তুলনায় তার বাবার কাছে তিনি কিছুই না। তবে এজন্য তাঁর অবশ্যই অপরাধ বোধ করা উচিত নয়। হাতের পিঠে চোখের পানি মুছে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে এখন তুমি কি করবে আরওরঙ্গজেব? তুমি কি আগ্রা যাবে?