শান্ত ভাবলেশহীন কণ্ঠে আওরঙ্গজেব বললেন, উঠুন। এ ধরনের অসংযত, লোক দেখানো বিনয় দেখাবার প্রয়োজন নেই। আমার যা দরকার, তা হল সুরাটে আপনার কার্যকলাপের সঠিক ব্যাখ্যা। কিভাবে আপনি ভূঁইফোড় শিবাজি আর তার পাহাড়ি দস্যুদের শহর লুট করতে দিলেন?
জাহাপনা, শহর রক্ষার জন্য আমার পর্যাপ্ত সেনা ছিল না। হাজার হাজার মারাঠি হঠাৎ আক্রমণ করে বসে। ওরা ধর্মোম্মাদ, নিজের জীবনের প্রতি ওদের কোনো দয়ামায়া নেই। তাছাড়া সুরাটের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আপনার সিংহাসনে বসার শুরু থেকেই ঠিক ছিল না।
আপনার আসলে মোট কতজন লোক ছিল?
ছয়শো পঞ্চাশের বেশি না।
আর কামান?
দশটি। তবে সবকটিই ছোট আর পুরোনো আমলের।
বাইরে থেকে কোনো বিপদ আসার খবর জানাতে নগরের সীমানার বাইরে প্রত্যন্ত এলাকায় ঘোড়সওয়ার টহলের ব্যবস্থা নেননি কেন?
টহলদার ছিল…তবে ঘোড়সওয়ার ছিল না। এখন বুঝতে পারছি জাহাপনা, তা যথেষ্ট ছিল না।
আরওরঙ্গজেব নীরবে সুবেদারের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সুবেদার তোতলাতে শুরু করলো, জাঁহাপনা, আমি সকল নগরবাসীকে নির্দেশ দিলাম, যার যার মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে জান বাঁচাতে গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিতে।
আপনিও তাই করলেন, তাই না?
সুবেদার মাথা নিচু করে বললো, হ্যাঁ।
সুরাট ছেড়ে চলে গেলেন আর এদিকে চারদিন ধরে নগরে লুটপাট চললো।
সুবেদার মাথা নেড়ে সায় দিল। হঠাৎ গলা শুকিয়ে যাওয়ায় তার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছিল না। সারা মুখে দরদর করে ঘাম ঝরছে, হলুদ রেশমি আলখাল্লার কাঁধ ঘামে ভিজে গেছে।
ইউরোপীয়রা কি করে তাদের সম্পদ রক্ষা করতে পারলো, অথচ আপনি পারলেন না?
আতঙ্কে সুবেদারের দুচোখের মণি কাঁপছিল, দুহাত ঘষতে ঘষতে সে বললো, জাহাপনা, ওদেরতো ছোট একটি জায়গা ছিল, আর আমাকে গোটা শহরের প্রতিরক্ষা দেখতে হয়। তারপর থেমে একবার ঢোক গিলে আবার বলা শুরু করলো, বিদেশিদের হাতে নতুন নতুন অস্ত্র ছিল…আর আমার লোকও ছিল খুব কম…ওরা ভয় পাচ্ছিল মারাঠিরা হয়তো…
আওরঙ্গজেব মনে মনে ভাবলেন, পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে সুবেদার বুঝতে পারে নি। যে, তিনি কতটুকু জানেন আর তার গুপ্তচরের জাল কতদূর ছড়িয়ে রয়েছে। তিনি বললেন, আপনার আগের বর্ণনা অনুযায়ী শহর রক্ষার জন্য, যে তিন হাজার সৈন্য নিযুক্ত করার কথা ছিল তার কি হল? তারপর আওরঙ্গজেব এক টুকরা কাগজ বের করে বললেন, আপনার স্বাক্ষর করা এই রশিদটি আমার খাজাঞ্চি আমাকে দিয়েছেন। রাজকীয় কোষাগার থেকে সেনাবাহিনীর খরচ জোগাতে আপনাকে বার্ষিক যে ভাতা দেওয়া হত এটি তার রশিদ। এই স্বাক্ষর আর সিলমোহর কী আপনার নয়?
এবার সুবেদার থর থর করে, কাঁপতে কাঁপতে আওরঙ্গজেবের সামনে হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়লো। কোনো উত্তর দিতে পারলো না। ভাতা গ্রহণ করে সেই টাকা দিয়ে সেনা নিয়োগ করা, তাদের বেতন দেওয়া আর তাদেরকে যথাযথ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত না করে পুরো টাকাটা সে আত্মসাৎ করেছে। এটা বুঝতে পেরে আওরঙ্গজেব কঠিন চেহারা নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনি শুধু আপনার ম্রাটের সাথে বেইমানি করেন নি, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল পবিত্র কুরআনের শিক্ষা ভঙ্গ করে আল্লাহর সাথেও বেইমানি করেছেন, যেখানে চুরি এবং দুর্নীতি নিষেধ করা আছে। উদ্ধত একজন কাফের এবং কিছু বিদেশি, যারা ইতোমধ্যেই আমাদের শাসনের প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়েছে, তাদের সামনে আমাকে আর আপনার ধর্মের অপমান করেছেন। যদি মারা যেতেন তাহলে আপনি একজন শহিদ হতেন। আর এখন কী হয়েছেন? একজন হীন কাপুরুষের মতো আপনার প্রভুর সামনে কাতর স্বরে কাঁদছেন। তবে আমি দয়ালু তাই আপনাকে পরকালে পাঠাবো না, তবে আপনার আর আপনার পরিবারের সমস্ত সম্পদ রাজকোষে সমর্পণ করবেন। যে পাপ করেছেন তা থেকে শুদ্ধ হতে একজন গরিব এবং নগণ্য তীর্থযাত্রীর মতো মক্কায় হজ করতে যাবেন। পথে যেতে যেতে ভিক্ষা করে যা পাবেন তা দিয়ে জীবন ধারণ করবেন। এখন আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যান!
সুবেদার মাটিতে বসে পড়েছিল, একবার দাঁড়াবার চেষ্টা করে আবার ঢলে পড়লো। দুজন প্রহরী তার দুই বাহু জাপটে ধরে তাকে টেনে নিয়ে চললো। সে পেছন পেছন মাটিতে হলুদ তরলের দাগ রেখে যেতে লাগল। কাপুরুষ লোকটি তার প্রস্রাব সামলাতে পারে নি।
আওরঙ্গজেব এবার তার সভাসদ আর সেনাপতিদের দিকে ফিরলেন। এই লোকটির পরিণতির কথা মনে রাখবেন। সাম্রাজ্যে কোনো ধরনের দুর্নীতি আমি সহ্য করবো না। আপনাদের মধ্যে কেউ তা লঙ্ঘন করলে আমি কোনো দয়া দেখাবো না। আর ঐ বেইমান শিবাজিকে নির্মূল করতে আমি ইতোমধ্যেই একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী পাঠিয়েছি। মোগল বংশের প্রতি সে যে অপমান করেছে, তার জন্য দুনিয়ার বুক থেকে তাকে মুছে ফেলা হবে। এবার আপনারা যেতে পারেন। নবোদ্যম নিয়ে আর নিঃস্বার্থভাবে দৃঢ়সংকল্প হয়ে যার যার দায়িত্ব পালনে লেগে পড়ুন।
রাত নেমে এসেছে আর এখন কাকের বদলে আকাশে বাদুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আওরঙ্গজেব খাসমহলের দিকে ফিরে চললেন। সেখানে পৌঁছে একাকী একটি চাবি নিয়ে ছোট একটি হাতির দাঁতের বাক্স খুলে একটা কাগজের টুকরা বের করলেন। সেখানে দাঁড়িয়েই শিবাজির কাছ থেকে যে চিঠিটা পেয়েছিলেন, তা আরেকবার পড়লেন। চিঠিটা কাউকে দেখান নি।