শিবাজি একমুহূর্ত ভাবলেন। দালান-কোঠাগুলোর চারপাশ ঘিরে থাকা উঁচু দেয়ালের চারদিকে অন্তত পঞ্চাশ ফুট খোলা জায়গা রয়েছে। তার লোকেরা এই জায়গাটুকু পার হতে ভীত নয়, তবে নিসন্দেহে কয়েকজন মারা পড়বে। শুধু শুধু তাদের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে কী লাভ? তাই তিনি বললেন, পিছু হটে পুরো দেয়ালটি ঘিরে ফেল আর নজর রাখা কেউ যেন এখান থেকে বের হতে কিংবা ঢুকতে না পারে। আমরা এখন মোগলদের কোষাগারের অনুসন্ধান করবো, তারপর বিদেশিদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।
ঘণ্টা দুয়েক পার হল, তবে পুরোনো নগর দুর্গটিতে কয়েকটি রূপার মুদ্রা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না। শিবাজি বুঝতে পারলেন ওরা আসল ধনভাণ্ডারের সন্ধান এখনও পায়নি, যা অবশ্যই আছে। দুটো বড় পাম গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে হতবুদ্ধি হয়ে তিনি ভাবছিলেন মূল ধনরত্নগুলো ওরা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। এমন সময় পাকাচুলের একজন মারাঠি সেনা-কর্মকর্তা তার কাছে এসে বললো, মহারাজ, আমার একজন লোক বলছে, যখন সে ঐ কুয়াটির কিনারায় চারপাশে পাথরের আস্তরণ দেওয়া অংশটির উপর পা ঠুকছিল তখন এক জায়গায় ফাপা আওয়াজ শুনতে পেয়েছে। তার ধারণা এর নিচে হয়তো কোনো গোপন কুঠরি থাকতে পারে। কুয়াটির পানিতে আমি একটি পাথর ফেলে দেখেছি, যেরকম ধারণা করেছিলাম ততটুকু গভীর মনে হল না। লোকটির কথাই হয়তো সঠিক।
ঠিক আছে, তাহলে ঐ পাথরের আস্তরণগুলো তুলে ফেল।
মারাঠিরা দ্রুত কাজে লেগে পড়লো। হাতের কাছে যা পেল তাই দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পাথরের আস্তরণগুলো তুলতে শুরু করলো। দশ মিনিটের মধ্যে ওরা একটা খাড়া সিঁড়ি দেখতে পেল, সোজা কুয়াটির নিচের দিকে নেমে গেছে। তালা দেওয়া একটি ধাতব বেষ্টনী দিয়ে ঢোকার পথটি বন্ধ করা ছিল। গাদা বন্দুকধারী একজন মারাঠি তালাটির মধ্যে একটু বারুদের গুঁড়া ঢেলে, আগুন লাগিয়ে দিয়ে পেছনে সরে দাঁড়াল। দপ করে আগুন জ্বলে উঠতেই একটা দুম শব্দ হল, তারপর তারের জালটি খুলে গেল। ধোঁয়া আর অন্ধকারের মধ্য দিয়ে শিবাজি ভেতরে কয়েকটি লোহার সিন্দুক দেখতে পেলেন। তিনি চিৎকার করে বললেন, সিন্দুকগুলো খোল। তার হুকুম তামিল করতে তার লোকেরা ছুটে এল। একটু পরই ভারি ডালাগুলো খুলতেই ভেতরে থরে থরে সাজানো সোনা রূপার মুদ্রা পাওয়া গেল।
ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে শিবাজি সবচেয়ে বড় সিন্দুকটির মুদ্রাগুলো পরীক্ষা করতে লাগলেন। সোনা-রূপার মুদ্রাগুলো তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে পড়ছিল। এমন সময় মোটাসোটা একজন মারাঠি সেনা-কর্মকর্তা তার কাছে ছুটে এল। এই লোকটি ইউরোপীয়দের আবাসের চতুর্দিক ঘেরাও করা সেনাদলের নেতৃত্বে ছিল। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে শুরু করলো, মহারাজ, ইউরোপীয়রা … এতটুকু বলেই সে দম নিতে থামলো।
বল, ইউরোপীয়রা কী?
ওরা তাদের জান-মাল রক্ষার বিনিময়ে মুক্তিপণের টাকা দেবার প্রস্তাব দিয়েছে।
হ্যাঁ বল, তারপর।
আরেকবার দম নিয়ে লোকটি আবার বলা শুরু করলো। সাদাচুলের দাড়িওয়ালা একজন ইউরোপীয় বণিক দুই হাত মাথার উপর তুলে জানালার সামনে এসে দাঁড়াল। সে আমাদের ভাষায় চেঁচিয়ে বললো, এখানে যে দায়িত্বে আছে, তার সাথে সে কথা বলতে চায়। আমি বাইরে এসে বললাম আমিই এখানে দায়িত্বে আছি। তখন সে কেবল বললো, আমরা তাদের কোনো ক্ষতি না করলে বণিকেরা আমাদেরকে কয়েক লাখ মুদ্রা দেবে। আমি তাকে জানালাম আপনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন, তবে আমি এখুনি আপনাকে কথাটি জানাচ্ছি।
শিবাজি একটু থেমে চিন্তা করলেন। ইউরোপীয়রা উন্নত অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত। শক্তিপ্রয়োগ করে ওদেরকে পরাজিত করতে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও অনেক সময় লেগে যাবে। আর এই ফাঁকে মোগলরাও আরো সৈন্য নিয়ে ফিরে আসতে পারে। মুক্তিপণের টাকার পরিমাণটি বিশাল। আর তার সাথে এই সিন্দুকগুলোর টাকা মিলিয়ে তার লোকদের লুটপাটের ক্ষুধা মেটানো ছাড়াও হিন্দুস্তানের অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে তার সমরাভিযানের খরচও দীর্ঘদিন চালানো যাবে। তাছাড়া এই বিদেশিদের শত্রু বানিয়ে কি লাভ, যেখানে শোনা যায় মোগলদের সাথে এদেরও সুসম্পর্ক নেই? এদের সমর্থন–বিশেষত ওরা যেসব আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র যোগান দিতে পারবে, তা আমাদের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার ভবিষ্যৎ লড়াইয়ে বেশ কাজে লাগবে। ওদেরকে বল আমি ওদের প্রস্তাব গ্রহণ করেছি।
*
দিল্লির লাল কেল্লায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই কাকগুলো তাদের বাসার খোঁজে কা কা চিৎকার করতে করতে ফিরে আসতে লাগলো। খাস মহল থেকে বের হয়ে সম্রাট আওরঙ্গজেব দুই পাশে সারবেঁধে মাথা নুইয়ে থাকা অমাত্য এবং সিপাহসালারদের মধ্য দিয়ে হেঁটে তিনদিক খোলা দিওয়ান-এ-আম-এর দিকে হেঁটে চললেন। ডানে বামে না তাকিয়ে মার্বেল পাথরের মঞ্চে উঠে তিনি তার পিতার রত্নখচিত সোনার ময়ূর সিংহাসনে বসলেন। দুধ সাদা সাধারণ আলখাল্লা পরা দীর্ঘ, হলকা-পাতলা গড়নে তার কঠোর আত্মসংযমী ব্যক্তিত্ব প্রকাশিত হচ্ছে। লম্বা সুন্দর হাতের আঙুলগুলো সিংহাসনের ঝলমলে হাতলে রাখলেন। কাঁচা-পাকা দাড়ি সুন্দরভাবে ছাঁটা। বাজপাখির মতো বাঁকা নাকের উপরে হাসিহীন কালো চোখদুটো হলুদ রেশমি পোশাকপরা সুরাটের সুবেদারের দিকে স্থির হয়ে রয়েছে। দুজন প্রহরী তাকে এগিয়ে নিয়ে আসছিল। মঞ্চের বারো ফুট দূরত্বে এসে সুবদার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে উপুড় হয়ে লম্বা হল।