লোকটি চলে যাওয়ার পর আওরঙ্গজেব কয়েক মিনিট বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দিল্লি শহরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। লোকজনের বিশ্বাসপ্রবণতা দেখে তিনি বিস্ময়াভিভূত হয়ে গেলেন। কোনো শুভ বা অশুভ লক্ষণ, জাদু আর ফকিরের বিভিন্ন ধরনের কেরামতি ও প্রলাপ বকার উপর তাদের অন্ধ বিশ্বাস তাদের কোনো আধ্যাত্মিক উন্নতি না করলেও তাদের অসুস্থ মনে ঠিকই প্রভাব ফেলে। হিন্দুস্তানের মানুষদেরকে তাদের ভুল দেখিয়ে দিয়ে সঠিক পথে আনাটা তার কর্তব্য। এটা করাটা তাঁর শাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে, যা তিনি নিজের জীবনে করেছেন। তবে তাঁর এখনকার কাজ হল এই অদ্ভুত সতনামি আর তাদের জাদুকরীকে দ্রুত সম্পূর্ণরূপে দমন করা। কেননা একবার এরা ছড়িয়ে পড়লে তার সার্বভৌমত্বের উপর হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু কি করে এটা করা সম্ভব, যেখানে তার বেশিরভাগ সেরা সেনা পাঞ্জাবে রয়েছে, এটা একটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঐ সেনা কর্মকর্তাটির আচরণ তাকে পরিষ্কার দেখিয়েছে যে, উদ্বেগ আর প্রায় আতঙ্ক কত দ্রুত সবচেয়ে অনুগত ব্যক্তিকেও প্রভাবিত করতে পারে।
শহরের দিকে তাকিয়ে তিনি মনে মনে একের পর এক সম্ভাবনার কথা ভাবতে লাগলেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল আর রান্নার চুলার আগুন অন্ধকার ভেদ করে ফুটকি দিয়ে জ্বলে উঠতে লাগলো। তারপর তাঁর মনে ধারণাটা এল। প্রচণ্ড অগ্নিকাণ্ড এড়াতে হলে তাকে আগুন দিয়েই আগুনের সাথে লড়াই করতে হবে। তাঁর নিজের লোকজন আর সৈন্যরা যদি জাদুমন্ত্র আর তাবিজ-কবচে বিশ্বাস করে, তাহলে তিনিও তাদেরকে দেখাবেন যে, তিনিও এসব প্রয়োগ করতে পারেন। মুসলিম সৈন্যদের রক্ষা করার জন্য ইমামদের বলবেন যথারীতি দোয়াকালামের ব্যবস্থা করতে আর যেসব হিন্দু বিভিন্ন দেবদেবীতে বিশ্বাস করে তাদের ব্যাপারেও হিন্দু পুরোহিতরাও সেরকম ব্যবস্থা নেবে। যারা একটু অনিচ্ছুক হবে, তাদের ক্ষেত্রে ‘দান করলে ঠিকই কাজ দেবে। সতনামিদের মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে সৈন্যরা দিল্লি ত্যাগ করার আগে এসব দোয়া আর মন্ত্র পার্চমেন্ট কাগজে লিখে কাগজগুলো পতাকায় সেলাই করে ইমাম আর পুরোহিতরা সেনাদলের সামনে প্রদর্শন করবে। পরের দিন সেনাবাহিনী যখন রওয়ানা দেবে, তখন সবার আগে এগুলো থাকবে। আর তাদের মনে সাহস যোগানোর জন্য তিনি নিজে এই সেনাদলের নেতৃত্ব দেবেন। এই বাহিনী মূলত্ব অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে গঠিত হবে, যাতে পায়ে হেঁটে আসা সতনামিদের বিরুদ্ধে দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করা যায়। তাছাড়া এদের বেশিরভাগই মাত্র কিছুদিন পূর্বে সাধারণ কৃষক ছিল।
*
আরেকবার তাঁর বিশাল যুদ্ধহস্তীর পিঠে সোনার পাতে মোড়া হাওদায় বসে আওরঙ্গজেব মাথার উপর হাত তুলে অশ্বারোহী বাহিনীকে সতনামিদের উপর আক্রমণ করার ইঙ্গিত দিলেন। ওরা তখনও এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করে অস্ত্র হাতে নেবার চেষ্টা করছিল। দিল্লি থেকে প্রায় বিশ মাইল দূরে ধীরে বয়ে চলা যমুনার একটি উপনদীর কর্দমাক্ত তীরে ওরা যখন রাতের জন্য শিবির স্থাপন করতে যাচ্ছিল, তখন তিনি তাঁর সেনাদল নিয়ে অতর্কিতে ওদের উপর আক্রমণ করলেন। তাঁর কথাই ঠিক ছিল। মুসলিম আর হিন্দু ধর্মগুরুরা যে প্রার্থনা তৈরি করে দিয়েছিলেন, তাতে সেনাদলের মনোবল বৃদ্ধি পেয়েছিল। ওরা মাত্র ছয় ঘণ্টায় দিল্লি থেকে এই দূরত্ব পেরিয়ে এসেছিল। এখন তার সৈন্যদের মধ্যে কোনো আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে না। বরং ওরা উল্লাসে চিৎকার করতে করতে বল্লম সোজা করে কিংবা তরোয়াল খাপমুক্ত করে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে। বিশেষত লখনৌ থেকে আসা মুসলিম আর রাজস্থান থেকে আসা হিন্দু সেনারা তাদের যার যার ধর্মীয় পতাকা উড়িয়ে চলছিল। দূরদর্শিতা দেখিয়ে তিনি তাদেরকে একেবারে সামনে না রেখে মাঝখানের সারিতে রেখেছিলেন, কেননা কোনো একজন পতাকাবাহীর মৃত্যু কিংবা দোয়া এবং মন্ত্ৰলেখা পতাকা কাদায় পড়ে গেলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
মুষ্টিমেয় কয়েকজন সামি ছুটে আসা মোগলদের দিকে তীর ছুঁড়লো। ঘাড়ে তীরের আঘাতে আহত হয়ে একেবারের সামনের একটি ঘোড়া মাটিতে লুটিয়ে পড়লো, সাথে সাথে এর সওয়ারিও ডিগবাজি খেয়ে ঘোড়াটির মাথার উপর দিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। আরেকজনের পায়ে তীর বিধতেই সে তার ঘোড়ার নিয়ন্ত্রণ হারাতেই ঘোড়াটি একপাশে ঘুরে গেল। যাইহোক আওরঙ্গজেব তার মাহুতকে বললেন তার অশ্বারোহীবাহিনীকে অনুসরণ করতে, যাদের প্রথম দলটি ইতোমধ্যেই সতনামিদের মাঝে ঢুকে পড়েছিল। তবে বেলুচি সেনা কর্মকর্তাটি যা অনুমান করেছিল তার চেয়ে সতনামিদের সংখ্যা অনেক বেশি মনে হল। এদের বেশির ভাগেরই হাতে ছিল তীর-ধনুক আর কৃষিকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি করা সাধারণ মানের বিভিন্ন হাতিয়ার।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সতনামিদের পতন শুরু হল। কেউ কেউ মোগল সেনাদের ঘোড়ার চাপে পিষ্ট হল আর অনেকে মোগল সেনাদের তরোয়ালে কাটা পড়লো। অনেকেই মরছিল, তবে আহত হলেও কেউ পেছন ফিরে পালাতে চেষ্টা করলো না। অর্ধনগ্ন কংকালসার দেহের একজন সতনামির মুখ তোয়ালে কেটে গেলেও সে তার কাস্তে দিয়ে ক্ষেতে ধান কাটার মতো ধীরে সুস্থে ছুটে চলা ঘোড়ার পায়ে আঘাত করে চললো। মাংসপেশি কেটে যাওয়ায় দুটি ঘোড়া হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল, তারপর একজন মোগল সেনা বর্শা দিয়ে তাকে গেঁথে ফেললো।