তিনি বললেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে! আমি তোমাকে অবিশ্বাস করার কথা ভাবি নি। মাথাটা বস্তায় ভরে ফেল। আমার কর্মচারী এটা সরিয়ে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলবে। ছোট ছোট দাড়িওয়ালা বেলুচি সেনা কর্মকর্তাটি–মুটি তোলার জন্য হাতড়িয়ে বেড়াল। মাথায় কোনো চুল না থাকায় কাজটা সহজ ছিল না। শেষপর্যন্ত এটা তুলে সে বস্তায় ভরলো আর একজন চাকর মাথাসুদ্ধ বস্তাটা এক হাত তফাতে রেখে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে কামরা থেকে বের হয়ে গেল।
আওরঙ্গজেব বললেন, “আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় না যে এধরনের অদ্ভুত সম্প্রদায় আছে–হিন্দুস্তানে বিভিন্ন ধরনের ভুল ধর্মীয় বিশ্বাস গজিয়ে উঠেছে। শুকর, গরু থেকে শুরু করে মাছ, মুরগি সবকিছু যেসব মানুষ খুশিমনে খায় আর যাদের এধরনের উদ্ভট প্রথা আছে, যেখানে নারী-পুরুষ একসাথে অংশ গ্রহণ করে, তারা কখনও আমার ক্ষমতার বিরুদ্ধে মোটেই হুমকি নয়। সে স্থানীয়ভাবে হোক আর ক্ষণস্থায়ীভাবেই হোক।’
‘জাহাপনা এটা সত্যি ওরা কি খায় তা নিয়ে ওরা মাথা ঘামায় না আর নারী ও পুরুষ একসাথে দল বেঁধে থাকে। তবে সমস্যা হচ্ছে এখান থেকে বেশি দূরে নয় এই দিল্লিতেই নারনউল নামে একটি স্থানে ওরা একজন ধর্মোন্মাদ নেতা পেয়েছে–তাও আবার পুরুষ নয়, জটপাকানো চুলের একজন বয়স্ক মহিলা। জ্বলজ্বলে চোখের মহিলাটি নিজেকে একজন জাদুকরী হিসেবে ঘোষণা করছে। সে এমন তীব্র ভাবাবেগ আর এমন বাচনভঙ্গি ব্যবহার করে যে, তার অনুসারীরা সম্পূর্ণ মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সে ওদেরকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে যে, যদি ওরা তার কথামতো কাজ করে তাহলে তার যাদুমন্ত্র আর যাদুর ওষুধ খেলে তলোয়ারের আঘাত আর বন্দুকের গুলি ওদের কিছুই করতে পারবে না। তার শক্তিতে ওদের এত গভীর বিশ্বাস জন্মেছে যে, বাহুতে তার বানিয়ে দেওয়া মন্ত্রপূত কবচ পরে ওরা তার নেতৃত্বে একটি-দুটি নয়, আমাদের বেশ কয়েকটি ছোট আকারের নগররক্ষী বাহিনীকে পরাভূত করেছে। অত্যন্ত ধীরে ধীরে গোপনে, ছদ্মবেশে কিংবা অনেক সময় নর্দমার মধ্য দিয়ে এমনকি মল-নর্দমার মধ্য দিয়ে ঢুকে ওরা ভেতর থেকেই হামলা করেছে। বিশ্বাস করুন জাঁহাপনা, গায়ে মলদূষণ হওয়া নিয়ে ওদের কোনো পরোয়া নেই। মোটেই পরোয়া করে না।
কর্মকর্তাটি একমুহূর্ত দম নেওয়ার জন্য থেমে আবার হুড়মুড় করে বলা শুরু করলো, ‘আচমকা যেন জাদুমন্ত্রে হঠাৎ উদয় হয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে যে, জাদুকরীর জাদুর মায়ায় ওরা দেয়াল ভেদ করে এসেছে আর ওরা অলঙ্নীয়। এতে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে আমাদের সমস্ত সেনা আর সেনা কর্মকর্তারা দুর্বল হয়ে সাহস হারিয়ে ফেলে। তারপর ওরা চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়ে পালিয়ে যায়। এই সতনামিদের আতঙ্ক এমন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে যে, ওরা এখনও মাত্র পাঁচহাজার হলেও পায়ে হেঁটে প্রকৃতপক্ষে কোনো বাধা ছাড়াই দিল্লির দিকে এগিয়ে আসছে। আর চলার পথে দলে দলে কৃষকরা ওদের সাথে যোগ দিচ্ছে। গুপ্তচরের যে মুণ্ডুটা আমি আপনাকে দেখিয়েছি, তাকে এখান থেকে মাত্র ত্রিশ মাইল দূরে একটা গ্রাম থেকে ধরেছিলাম। আমি খবর পেয়েছি ওদের মূল দলটি দিল্লি থেকে এর দ্বিগুণ দূরত্বে রয়েছে। এভাবে তাড়াতাড়ি আলুথালু বেশে আপনার সামনে হাজির হওয়ার জন্য অনুগ্রহ করে আমাকে মার্জনা করবেন সঁহাপনা। তবে আমার মনে হয় আত্মরক্ষা করার মতো যথেষ্ট সৈন্য আমাদের হাতে নেই। কারণ আমাদের মূল সেনাবাহিনী এখন পাঞ্জাবে শিখদের মোকাবেলা করছে। আমি সত্যি আতঙ্কিতবোধ করছি। তারপর সে নীরব হল।
আওরঙ্গজেব কঠোর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শান্ত হও, জওয়ান। আমাদের সিপাহিদের আতঙ্ক মনে হচ্ছে এমন ছোঁয়াচে যে, তা তোমার গলায় চেপে বসেছে। একজন সেনা কর্মকর্তার মনের ভেতরের উদ্বেগ যাইহোক, তা বাইরে প্রকাশ করা যাবে না। এটা তুমি ঠিক বলেছ যে আমাদের সেনাবাহিনীর মূল অংশ গুরু তেগ বাহাদুরের নেতৃত্বে শিখদের মোকাবেলা করছে। তবে ওদের তাই করার কথা। শিখরা আমাদের শাসনের বিরুদ্ধে একটি দীর্ঘস্থায়ী হুমকি। ওরা সাহসী, সুশৃঙ্খল আর উন্নত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। ওদের ধর্মমত–আমাদের মতো না হলেও, তুমি যে জাদুকরীর প্রলাপ বকার কথা বলেছ তার চেয়ে অনেক সুসঙ্গত। সেনা কর্মকর্তাটি কাঁধ সোজা করে দাঁড়াল, তবে তার চেহারায় তখনও উদ্বেগের ছাপ রয়ে গেছে। সে বললো, জাহাপনা, আমি অসঙ্গত আপনাকে আতঙ্কিত করতে কিংবা নিজেকেও অতিরিক্ত আতঙ্কগ্রস্ত দেখাতে চাই নি। সেনাবাহিনীকে কোথায় আপনি মোতায়েন করবেন, সে ব্যাপারে আপনার সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি উদ্বিগ্ন–আর স্বীকার করছি এখনও তাই বুঝতে পারছি না কেমন করে এই সতনামিদের প্রতিরোধ করবো।
আওরঙ্গজেব বললেন, ‘সে ভাবনা আমার। এখন তুমি যাও, বিষয়টা নিয়ে আমাকে ভাবতে দাও।’ তারপর সেনা কর্মকর্তাটি ঝুঁকে তাঁকে সালাম জানিয়ে দরজার দিকে এগোতেই আওরঙ্গজেব নরম কণ্ঠে বললেন, ‘এত তাড়াতাড়ি ছুটে এসে খবরটা দিয়েছ, সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ। এধরনের হুমকির খবর যত তাড়াতাড়ি আমি পাবো তত দ্রুত আমি ওদের মোকাবেলা করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারবো।’