সুরাটের উপরের দিকে তাকিয়ে শিবাজি শহরের দক্ষিণ দিকের বন্ধ ফটকের ঠিক পেছনে একটি দুই-তিনতলা ভবনের সমতল ছাদে গাদা বন্দুকধারী একদল মোগল সেনার ছায়ামূর্তি দেখতে পেলেন। লোহার দণ্ড দিয়ে ঠেলে ঠেলে বন্দুকের নলে বারুদ ভরে তারা আবার গুলি ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বামহাতে ঘোড়ার মুখ সেদিকে ঘুরিয়ে শিবাজি চিৎকার করে উঠলেন, ওরা বন্দুকে বারুদ ভরার আগেই ফটকের দিকে ছোটো। সেই সাথে ডান হাতের তরবারি দিয়ে ছুটে পালানো একজন মোগল সেনার পিঠে আঘাত করলেন। শীঘ্রই তার কয়েকজন লোকসহ তিনি ফটকের কাছে পৌঁছলেন। তিনি আশা করছিলেন, ভেতরে যারা আছে তারা হয়তো ফটকের দরজা একটু ফাঁক করবে যাতে তাদের ছুটে আসা সঙ্গীরা ভেতরে ঢুকতে পারে। কিন্তু না, কঠিন মনের আত্মরক্ষাকারীরা যথেষ্ট বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন, তারা বরং তাদের সাথিদেরকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেবে, কিন্তু তাকে ভেতরে ঢুকার সুযোগ দেবে না।
শিবাজি দ্রুত ভাবতে লাগলেন, তাহলে কিভাবে তিনি লোকজনসহ শহরের ভেতরে ঢুকবেন?
একবার ভাবলেন ঘোড়ার পিঠ থেকে দেয়ালে চড়লে কেমন হয়? না, প্রায় বার ফুট উচ্চতা খুব বেশি হয়ে যায়। একজনের উপর একজন দাঁড়িয়ে মানব-সিঁড়ি তৈরি করলে কেমন হয়? না, এটাও খুব ঝুঁকিপূর্ণ আর অনেক সময় লাগবে। তারপর হঠাৎ তার চোখে পড়লো একটি জংধরা ছোট কামানের নল মাটির দেয়ালের ছায়ায় পড়ে রয়েছে। তিনি চিৎকার করে বললেন, ঐ কামানের নলটা নাও, ওটাকে দুরমুশ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। ঘোড়ার পিঠ থেকে এক লাফে নেমে তিনি মাটিতে পড়ে থাকা কামানের নলটির দিকে ছুটলেন। তার কয়েকজন দেহরক্ষীও তাকে অনুসরণ করলো। এদের মধ্যে একজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে আবার উঠে দাঁড়াল। একটু পরই বর্মের নিচে ঘামতে ঘামতে আটজন লোকসহ শিবাজি কামানের নলটি তুলে ফটকের সামনে বয়ে নিয়ে এলেন।
একজন মারাঠি বললো, রাতেরবেলা ওরা বামদিকের যে ছোট দরজাটা ব্যবহার করে সেটার উপর আঘাত করলে হতো না?
শিবাজি উত্তর দিলেন, ভালো কথা বলেছে। তিন বলার সাথে সাথে এর কজা লক্ষ্য করে আঘাত কর। হাঁপাতে হাঁপাতে ওরা কামানের ভারি নলটি একবার পেছনের দিকে নিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে ছোট দরজাটির কজা লক্ষ্য করে আঘাত করলো। কোনো ফল নেই। আবার! এবার দরজার কিছু কাঠের টুকরা ভাঙ্গলেও, দরজাটি জায়গা মতোই রইল। আরো জোরে! তৃতীয় আঘাতে দরজাটি কজা থেকে খুলে এল। শক্তিশালী গড়নের একজন তরুণ দেহরক্ষী প্রথমে ঢুকলো, তারপর শিবাজি আর তার প্রায় বিশজন সেনা তাকে অনুসরণ করলো। একটু নিচু হয়ে ওরা দালানটির দিকে ছুটে চললো, যেখান থেকে মোগলরা গুলি ছুঁড়ছিল। হঠাৎ একজন মোগল সেনা গুলি ছুঁড়তেই তরুণ দেহরক্ষীটির পায়ে গুলি লাগতেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। একজন মারাঠি সেনার হাতে বারুদভরা গাদা বন্দুক ছিল, সে ধীরে সুস্থে লক্ষ্য স্থির করে গুলি ছুঁড়লো। সবুজ জ্যাকেটপরা একজন মোগল সেনার শরীর মুচড়ে উঠলো, হাত পা ছুঁড়ে ছাদের উপর থেকে সে মাটিতে পড়ে গেল। মাটিতে পড়ে তার মাথা ফেটে ঘিলু বেরিয়ে গেল। বাদবাকিরা ছাদ থেকে লাফিয়ে নেমে পালাবার চেষ্টা করতে লাগলো। তবে মারাঠিরা তাদের উপর চড়াও হয়ে তলোয়ার চালাতে লাগলো, কেউ ছাড়া পেল না।
শিবাজি আর তার লোকজনেরা একটু দম নেবার জন্য থামতেই একজন মারাঠি। দৌড়ে উপরে এসে বললো, মহারাজ, মোগলরা শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। অস্ত্রসহ বড় একটি দল ঘোড়ায় চড়ে উত্তর দিকের ফটক দিয়ে পালাচ্ছে। মনে হল ওদের মধ্যে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাও আছে। অন্যরা নৌকা বেয়ে বন্দরে অপেক্ষমাণ মোগল জাহাজের দিকে যাচ্ছে। জাহাজগুলো ইতোমধ্যে পাল তুলতে শুরু করেছে।
কাপুরুষের দল। ওদের টাকা-কড়ি কোথায় আছে খোজো–নির্দয়ভাবে আওরঙ্গজেব যে করের বোঝা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে…তবে শহরের সাধারণ মানুষের কোনো ক্ষতি করো না। আমাদের মতো ওরাও মোগলদের হাতে অত্যাচারিত হয়েছে। তবে নিয়মানুযায়ী অনুসন্ধান করবে। মোগলরা ওদের রত্নভাণ্ডার ভালোমতোই লুকিয়ে রাখে।
শিবাজি নিজে কয়েকজন লোক নিয়ে বন্দরের সামনের দিকে মুখ করা গুদামগুলোর একটির দিকে চললেন। তবে ওরা সাবধানে দালানের দেয়াল ঘেঁসে চললো, কেননা মোগলদের পালিয়ে যাওয়াটা একটি ফাঁদও হতে পারে। কিংবা ছাদে আরো মোগল সেনা ওঁৎ পেতে থাকতে পারে। তবে সৈকতে পৌঁছে ওরা দেখলো সব একেবারে নীরব। সকালের রোদে সাগরের পানি চিকচিক করছে। ওরা জনশূন্য জাহাজঘাট ঘুরে দেখলো, অন্যসময় জায়গাটি জনসমাগমে সরগরম থাকতো। বড় বড় কতগুলো উজ্জ্বল হলুদ রঙের কাপড়ের গাঁট জাহাজঘাটে পড়ে রয়েছে। কুলিরা যেখানে ফেলে রেখে পালিয়েছে, সেখানেই পড়ে রয়েছে। ফেলে রাখা দুটো পিপা থেকে মরিচ ধুলায় পড়ে রয়েছে। সৈকতে আছড়ে পড়া ছোট ছোট ঢেউয়ের শব্দ আর মাঝে মাঝে দু একটা গাংচিলের চিৎকার ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
শিবাজি তার লোকজনসহ নিঃশব্দে বেলেপাথরের কয়েকটি বড় বড় দালানের চারপাশ ঘিরে থাকা একটি উঁচু ইটের দেয়ালের দিকে এগোলেন। হঠাৎ একটি বন্দুকের গুলি শিবাজির কানের পাশ দিয়ে ছুটে গেল। আরো কয়েকটি গুলি তার পায়ের চারপাশে ধুলি উড়িয়ে গেল। একজন মারাঠি তার রক্তাক্ত পায়ের ডিম ধরে মাটিতে পড়ে গেল। শিবাজি চেঁচিয়ে উঠলেন, সবাই যে যেখানে পারো লুকাও। গুলি আসছিল ইটের দেয়ালঘেরা আঙিনাটি থেকে। গুপ্তচরের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে শিবাজি অনুমান করলেন এই দালানগুলোতে নিশ্চয়ই ইউরোপীয় বণিকরা থাকে। তার ধারণা সত্য প্রমাণিত হল যখন একটি দালানের উপরের তলা থেকে সাদা চামড়ার একজন মানুষ জানালা দিয়ে মুখ বের করে সাবধানে উঁকি দিল। গাদা বন্দুক হাতে আরেকটি লোক জানালার সামনে এসে দ্রুত একবার গুলি করেই বসে পড়লো। আরেকজন মারাঠি সেনা পড়ে গেল, রক্তে তার সাদা জামা লাল হয়ে গেল। তার একজন সঙ্গী সামনে ছুটে এল, তারপর তার কাঁধের নিচে হাত দিয়ে ধরে তাকে কাপড়ের গাঁটরির আড়ালে টেনে নিয়ে গেলো।