রওশনআরা স্থিরদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। তাঁকে কিছু একটা বলতেই হবে।
তিনি বললেন, রওশনআরা, তুমি সম্পূর্ণ ভুল ভেবেছ যে, আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ নই। আমি অবশ্যই তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ। সেই শুরু থেকেই আমার সংগ্রামের দিনগুলোতে তুমি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছ যখন খুব কম লোকই তা করেছিল। আর হ্যাঁ, আমি অবশ্যই তোমাকে ভালোবাসি… একথাটা জিজ্ঞেস করার দরকার পড়ে না। আমি…’ একটা মুহূর্ত তিনি অনুভব করলেন তিনি দুর্বল হয়ে বলতে যাচ্ছিলেন সেই কথাটা, যা রওশনআরা তার মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছিলেন। তারপর নিজের মনকে শক্ত করে বললেন, আমাকে এখন যেতে হবে। তবে আমি তোমার আরোগ্যলাভের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চাইবো, আমার মোল্লাদেরকেও দোয়া করতে বলবো। এক টুকরা কাপড়ের কোণা গোলাপজলে ভিজিয়ে তার মুখ থেকে ঘাম মুছলেন তারপর তার কপালে একটা চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগোলেন।
‘আওরঙ্গজেব…’
তিনি তাঁর ক্ষিণ কণ্ঠের ডাক শুনলেন, তবে আর ফিরে তাকালেন না। আর কি বলবেন তাকে? তিনি তাঁর বোন এবং তিনি তাকে ভালোবাসেন, তবে এর বেশি আর তিনি তাঁকে সান্ত্বনা দিতে পারেন না। তাঁর নিজের কথাতেই তিনি স্বীকার করেছেন যে, তিনি একজন পাপী।
পাশের ছোট ঘরটিতে সবাই অপেক্ষা করছিলেন, জাহানারা একটু তফাতে দাঁড়িয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব তাঁর একহাত ধরে বললেন, তাঁর অবস্থার কোনো ধরনের পরিবর্তন হলে আপনি সাথে সাথে আমাকে খবর দেবেন। জাহানারা মাথা কাত করে সায় দিলেন। মহিলারা সবাই আবার রোগীর কামরায় ঢুকতেই তিনি সেখান থেকে বের হয়ে উদিপুরীর মহলে না গিয়ে তাঁর নিজের কামরায় গেলেন। তিনি কথা দিয়েছিলেন, তাই সেখানে পৌঁছে মার্বেল পাথরের মেঝেতে জায়নামাজ বিছিয়ে রওশনআরার জন্য নামাজে বসলেন। যখন নামাজ শেষ করলেন, একটুকরো সোনালি আলোর ছটা জানালার খড়খড়ি দিয়ে ভেতরে এসে পড়লো। মুখে সূর্যের আলোর প্রয়োজন অনুভব করে তিনি বারান্দায় বের হয়ে এলেন। দিগন্তের উপর সূর্যের সোনালি চাকাটি উঠে আসতেই নতুন একটি দিনের শুরু হল। একটু সময় তিনি নিবিষ্টভাবে অবলোকন করলেন, যে দিল্লি নগরী তাঁর সামনে ছড়িয়ে রয়েছে। প্রথম উনানের ধুয়া চক্রাকারে ভোরের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
একটুপরই তাকে সভাসদের সাথে আলোচনায় বসতে হবে। বোনের এমন অসুস্থতা তার উপর তার লজ্জানক স্বীকৃতির কথা বাদ দিলেও, রাজকাজে মন বসাতে তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু দায়িত্ব পালন করতেই হবে। এটা তাঁর দায়িত্ব-কর্তব্য, তাছাড়া আরো কিছু জরুরি বিষয় নিয়ে তাঁকে কথা বলতে হবে। বিশেষত হিন্দু কৃষক আর ছোট ছোট বণিকদের ভিন্ন মার্গের এক সম্প্রদায়ের খবর এসেছে, যারা ভিনদেশী প্রথা অনুসরণ করে, তার একজন সুবেদার সতর্কবার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছে যে, এরা প্রজাবিদ্রোহ প্রচার করছে।
ভেতর গিয়ে সুবেদারের পাঠানো প্রতিবেদনটি তুলে নিলেন, যাতে মন্ত্রণাসভায় যাওয়ার আগে আরেকবার পড়ে নিতে পারেন। তবে রওশনআরার চিন্তা তার মনোযোগ বার বার সেদিকে নিয়ে যাচ্ছিল। দুজনের মাঝে বয়সের ব্যবধান মাত্র একবছরের ছোটবেলায় তারা কত কাছাকাছি ছিলেন। যেরকম তাদের বড় দারা আর জাহানারা ছিলেন। রওশনআরার একটি পোেষা বেঁজি ছিল, যা নিয়ে তিনি মাঝে মাঝে খেলা করতেন। তাদের মায়ের মৃত্যুর পর দুজনের মনে যে দুঃখযাতনা হয়েছিল, তা ওদের দুজনকে আরো নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করেছিল…অথচ একটু আগে রওশনআরা অভিযোগ করলেন যে, তিনি একাকীত্বে ভুগছিলেন আর এর জন্য তাকেই দায়ী করলেন। কখন তিনি এটা বুঝতে পারলেন যে, একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আল্লাহ তাঁকে নির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন আর তা অর্জনের জন্য তিনি কাউকে আস্থায় নিতে পারবেন না–রওশনআরাসহ আর সবাইকে বাদ দিয়ে সমস্ত ভাবনা নিজের মনে রাখতে হবে? যদিও তারপর থেকেই কারও প্রয়োজন কিংবা কারও উপর নির্ভর না করার জন্য তিনি নিজেকে প্রশিক্ষিত করে তুলেছিলেন, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তিনি তাঁর বোনকে ভালোবাসেন না। নিশ্চয়ই রওশনআরা তা বুঝতেন? নিজের শালীনতার সীমা অতিক্রম করার কারণে তিনি আওরঙ্গজেবকে দোষারোপ করতে পারেন না। এর জন্য দায়ী তাঁর নিজের লালসা, আওরঙ্গজেবের ব্যর্থতা নয়।
‘আওরঙ্গজেব…’ ডাক শুনে ঘুরে তিনি জাহানারার দিকে তাকালেন। সব শেষ। আমার হাতে মাথা রেখেই সে মারা গেছে। তবে মারা যাওয়ার আগে কেবল তোমার নাম উচ্চারণ করছিল। আর শেষ মুহূর্তটিতে তার মুখে মৃদু হাসির রেখা ছিল–এমন মিষ্টি সে হাসি–আর এমনভাবে আমার দিকে তাকাল ঠিক যেরকম ছোটবেলায় তাকাত…’। জাহানারার দুগাল বেয়ে চোখের পানি নেমে এল, তিনি তার ভাইয়ের কাছে এগিয়ে তাঁকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন।
*
‘চেয়ে দেখুন জাঁহাপনা। ওদের চেহারা সম্পর্কে যা শুনেছিলাম তা সত্যি। পাটের বস্তার ভেতর থেকে কাটা মুণ্ডুটা সাদা মার্বেল পাথরের মেঝেতে পড়ে সামান্য গড়িয়ে তারপর থামল। খোলা বিস্ফোরিত চোখদুটো আওরঙ্গজেবের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মুণ্ডুটা দেখতে একটু অদ্ভুত ধরনের। যে কর্মকর্তাটি লোকটিকে একজন গুপ্তচর হিসেবে পাকড়াও করে কোতল করেছিল, সে বলেছিল এদেরকে ‘সতনামি’ বলা হয়। এরা মাথার চুল আর ভ্রূ কামিয়ে ফেলে। গুপ্তচরটির বেশ আগে মৃত্যু হয়েছিল, মুণ্ডুটির চামড়ায় বিভিন্ন ধরনের নকশা ছিল আর ইতোমধ্যে এতে পচন ধরতে শুরু করেছে। গা বমি বমি করা মৃত্যুর গন্ধ আওরঙ্গজেবকে অসুস্থ করে তুললো।