আওরঙ্গজেবের বিশ্বাসই হচ্ছিল না, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এনার কি হয়েছে? খুব খারাপ কিছু হয়েছে? তার যতদূর মনে পড়ে ছেচল্লিশ বছরের জীবনে তিনি একদিনের জন্যও রওশনআরাকে তেমন অসুস্থ হতে দেখেন নি।
‘আমরা এখনও কোন কিছুতে নিশ্চিত হতে পারি নি, জাঁহাপনা। মাত্র কয়েকমিনিট আগে আমরা এসেছি। তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি তার শরীরের তাপমাত্রা খুব বেড়ে গেছে আর তিনি একটু পর পর জ্ঞান হারাচ্ছেন। হৃৎস্পন্দনও খুব দ্রুত হচ্ছে। হৃৎস্পন্দনের গতি কমাবার জন্য আমি আমার সহকর্মীকে সামান্য রক্ত বের করতে বলেছি। তাছাড়া তাকে শান্ত করে জ্বর কমাবার জন্য আফিম গাছের রস দিয়ে একটা নির্যাস বানিয়েছি।’
আওরঙ্গজেব বিছানার অন্যপাশে হাঁটুগেড়ে বসে রওশনআরার বামহাতটি তার নিজের হাতে তুলে নিয়ে বললেন, রওশনআরা…’ হাতটা খুব ভারী আর প্রাণহীন মনে হলো যেন, তাঁর আত্মা তার দেহ ছেড়ে চলে গেছে। রওশনআরার দুচোখ বন্ধ আর হেকিমরা যেরকম বলেছিলেন, ঘামে ভেজা পাতলা চাদরের নিচে তার বুক দ্রুত উঠানামা করছিল। তিনি তাঁর হাতটা একটু মুচড়ে ধরতেই রওশনআরার দুচোখের পাতাগুলো তিরতির করে কেঁপে উঠলো। রওশনআরা এটা আমি …আওরঙ্গজেব।’
ধীরে ধীরে মনে হল অনেক কষ্ট করে রওশনআরা চোখ খুললেন। তাঁর দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকা সত্ত্বেও তাকে একটু বিভ্রান্ত মনে হচ্ছিল। তিনি কোনোমতে বললেন, আওরঙ্গজেব…এটা কি আসলেই তুমি?
হ্যাঁ অবশ্যই আমি। তুমি এখনও অসুস্থ বোন। হেকিমসাহেবরা এসেছেন, ওরা বলেছেন শীঘ্রই তোমাকে সুস্থ করে তুলবেন।’ কথাটা বললেও তাতে খুব জোর ছিল না, এমনকি নিজের কানেও তেমন মনে হল না। হেকিম না বললেও তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন যে তাঁর বোন খুবই অসুস্থ–এটা তার চেহারা দেখে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে।
‘আওরঙ্গজেব…আমি তোমার সাথে একটু একা কথা বলতে চাই। দয়া করে অন্যদেরকে চলে যেতে বল।
আওরঙ্গজেব পেছন ফিরে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা দলটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দয়া করে কিছুক্ষণের জন্য আমাদেরকে একা রেখে আপনারা বাইরে যান। তারপর হেকিম দুজনের দিকে মাথা নেড়ে বললেন, আপনারাও একটু বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করুন। তরুণ চিকিৎসকটি তখন মাত্র রওশনআরার রক্ত নেওয়া শেষ করেছিলেন। এখন তিনি সাদা মসলিনের কাপড় দিয়ে দ্রুত রওশনআরার হাতে একটা পট্টি বেঁধে দিলেন, তারপর যন্ত্রপাতির চামড়ার ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে অন্যান্যের অনুসরণ করে বাইরে চলে গেলেন।
‘এখন আমরা একা, রওশনআরা বল।
তিনি আবার চোখ বুজলেন। আওরঙ্গজেব তার মুখের উপর থেকে মেহেদি রং করা একগুচ্ছ চুল টোকা দিয়ে সরিয়ে দিতেই রওশনআরা আবার কথা বলা শুরু করলেন। তবে এত আস্তে বলছিলেন যে, কথাগুলো শোনার জন্য আওরঙ্গজেব তার কাছে আরেকটু ঝুঁকলেন। কি বলতে চাচ্ছেন তিনি? আওরঙ্গজেবের মনে হল তিনি শুনতে পেলেন, “আমি দুঃখিত…খুবই দুঃখিত… আমি এটা বুঝাতে চাই নি…তোমাকে বুঝতে হবে।
রওশনআরা অস্থির হয়ো না। চুপ করে শোও।
না, আমাকে বলতেই হবে,,’ এবার তার কণ্ঠস্বর পরিষ্কার হল আর তিনি চোখ খুললেন। কোনোমতে শক্তিসঞ্চয় করে নিজেকে একটু উপরের দিকে উঠিয়ে বালিশে হেলান দিলেন। তারপর একটু দম নিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘আওরঙ্গজেব, দয়া করে আমার কথা শোন। আমি জানি আমি… আমি তোমাকে হতাশ করেছি। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিল না…আমি মদ খেয়েছিলাম, কেননা এতে আমি আনন্দ পেয়েছিলাম। আর আমি তোমার সাথে প্রতারণা করবো না, এমন একসময়ে যখন মৃত্যু আমার কাছে চলে এসেছে… দুই-একবার আমি গোপন প্রণয়ী নিয়েছিলাম, ঠিক যা তুমি সন্দেহ করেছিলে। খুব কঠিনভাবে আমাকে বিচার করো না… আমি শুধু চেয়েছিলাম কেউ আমাকে নিয়ে ভাবুক… কারও কাছাকাছি হতে চেয়েছিলাম… একটু উষ্ণতা অনুভব করতে চেয়েছিলাম। যাইহোক আমি চেষ্টা করেছিলাম–এমনকি যখন জাহানারা বাবার সাথে আগ্রা দুর্গেছিলেন আর আমি ছিলাম তোমার পাশে। যদিও আমার মনে সন্দেহ ছিল তোমার আসলে আমাকে প্রয়োজন নেই কিংবা আমার ব্যাপারে তোমার কোনো মাথাব্যথা নেই। তোমার জন্য এতকিছু করার পরও তুমি শুধু আমাকে সয়ে করে গেছ। এটা ঠিক নয়, আওরঙ্গজেব। এমনকি জাহানারা মুক্ত হওয়ার আগেও আমি অনুভব করেছি যে তুমি আমাকে একপাশে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছ, যেন আমার কোনো গুরুত্ব নেই। আমি একা হয়ে পড়লাম, যেরকম প্রায় সারাজীবন ছিলাম–মা মারা যাওয়ার পর থেকে। এরকম ভাবা কি ভুল ছিল? আমার মনে হচ্ছে আমার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে…আমার মনে হয় আমার আর বেশি সময় নেই। আমি কী জাহানারার মতো তোমার কাছে আপন? দয়া করে বল?
আওরঙ্গজেব হতবাক হয়ে গেলেন, তার মুখে কোনো কথা জোগাল না। তাহলে গোপন প্রেমিক নেবার কথাটা তাহলে সত্যি…তিনি বুঝতে পারলেন তিনি আর রওশনআরার কপালে হাত বুলাচ্ছেন না। তাঁর যন্ত্রণাকাতর মুখ দেখে অনেক চেষ্টার পর এক হাত বাড়িয়ে আবার তার কপাল ছুঁলেন। এমনকি যে সময়ে তাঁর নিজের কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার কথা, তখনও তার মনে জাহানারার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। তাঁকে মিনতি করছেন বলার জন্য যে, জাহানারা নয় তিনিই তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই পৃথিবীতে তাঁর শেষ মুহূর্তে হয়তো কয়েকটি মিষ্টি কথা তাকে শান্ত করবে, তবে তিনি মিথ্যা কথা বলতে পারবেন না, বলবেনও না, বিশেষত সেই নারীকে যে এমন ঘোরতর পাপ করেছেন।