কিন্তু তাঁর বোন তার কথায় কান দিলেন না। বরং তিনি পেছনে ঘুরে কামরা থেকে বের হয়ে গেলেন। জাহানারা তাঁর বোনের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তবে একমুহূর্ত পর তিনি আর তার বোনের রাজকীয় অবয়বটা দেখছিলেন না, তাঁর চোখে তখন ভেসে উঠেছে একটি যুবকের চেহারা। চুল আর গায়ের রঙ গমের মত আর চোখ দুটো গ্রীষ্মের আকাশের মত নীল। রওশনআরা ভুল বলেছিলেন। তিনি আর নিকোলাস প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলেন না। তবে দুজনের মাঝে বিচ্ছেদের পর এতগুলো বছরে তিনি কখনও তার কথা ভুলতে পারেন নি আর ভাবতেন অন্য জীবনে কি হবে কে জানে…’
*
বাদামি ঘোড়ায় চড়ে আওরঙ্গজেব লাহোর দরজা দিয়ে দিল্লির লালকেল্লায় প্রবেশ করলেন। তার আগে আগে চলা দেহরক্ষীবাহিনীর বুকের বর্মে বিকেলের রোদ ঠিকরে পড়ে ঝিকমিক করছিল, মূল সেনাবাহিনী আরো পেছনে রয়েছে। জাটদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করায় তিনি নীরবে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। কিছুক্ষণ পর সূর্য দিগন্তের নিচে ডুবে যাওয়ার পর তিনি হাতির পিঠে চড়ে শহরের রাস্তা দিয়ে জামে মসজিদে গিয়ে আন্তরিকতার সাথে নামাজ আদায় করবেন। সাদা কারুকাজ করা বেলে পাথরের মসজিদটি পুরো সাম্রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর আর সবচেয়ে বড়। তাঁর বাবা শাহজাহানের আমলে পাঁচহাজার শ্রমিক আর কারিগরের ছয় বছর লেগেছিল এটা নির্মাণ করতে আর দশ লক্ষ রুপিরও বেশি খরচ পড়েছিল। এটি তার বাবার এমন একটি কীর্তি যার জন্য তিনি সত্যি গর্ববোধ করেন।
আওরঙ্গজেব ঘোড়া নিয়ে কেল্লার বিশাল আঙিনায় ঢুকলেন। পরে তিনি তার সেনা কর্মকর্তাদের ডেকে এনে পুরস্কারস্বরূপ, টাকা, ঘোড়া, সুন্দর তরোয়াল আর সম্মানসূচক আলখাল্লা বিতরণ করবেন, যারা গোকলার বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানে বিশেষ বীরত্বসূচক অবদান রেখেছিল। তবে এখন তাঁর মন কেবল উদিপুরী মহলের দিকে কেন্দ্রীভূত হয়ে রয়েছে, যিনি মাত্র চার দিন আগে তাঁকে একটি পুত্র সন্তান উপহার দিয়েছেন। এটা আরেকটি শুভ লক্ষণ যে, উপর থেকে তাঁর উপর আশীর্বাদ বর্ষিত হচ্ছে।
তিনি হেরেমে ঢুকতেই একটার পর একটা দরজা খুলে গেল আর তার কানে বাজতে লাগলো, ‘সম্রাট আসছেন’ চিৎকারটি। রওশনআরার মহলে ঢোকার দরজার কাছাকাছি পৌঁছার পর তিনি সেখানে দাঁড়ালেন না। এখন তার বোনের সাথে দেখা করার ইচ্ছা নেই আর তিনি হয়তো সেখানে নেই। খুব সম্ভব অন্যান্য বোনদের সাথে তিনি এখনও জালি দেওয়া বেলকনিতে রয়েছেন, যেখান থেকে রাজকীয় মহিলারা তাঁর আনুষ্ঠানিক আসা-যাওয়া লক্ষ করতে পারেন। তবে উদিপুরী তাঁর জন্য অপেক্ষা করে রয়েছেন…
মহলে ঢুকতেই তিনি গোলাপ আতরের খুশবু পেলেন, এটা উদিপুরী মহলের প্রিয় সুগন্ধি, ঠিক যেরকম তাঁর মা মমতাজের তা ছিল। দরজার বাইরে হেরেমের দাঁড়ান পরিচারকের প্রতি ইশারা করে তাকে চলে যেতে বলে তিনি ভেতরের কামরায় ঢোকার দরজা ঠেলে খুললেন। চৌকাঠে পা দিয়েই তিনি থমকে দাঁড়ালেন। উদিপুরী কৌচের উপর আধশোয়া হয়ে রয়েছেন। লম্বা কালো চুল কাঁধের উপর এসে পড়েছে আর তিনি একমনে তার বাচ্চার দুধ খাওয়া দেখছেন। সেই সুদূর ককেশাস পর্বত এলাকায় তাঁর নিজ দেশ জর্জিয়ায় যত উচ্চ পরিবারেরই হোন, কোনো মা তার বাচ্চাকে দুধ খাওয়াবার জন্য ধাত্রী রাখেন না। কি সুন্দর দৃশ্যটি–মা আর তাঁর সন্তান তার মায়ের নীল শিরাওয়ালা শুভ্র মসৃণ স্তন থেকে দুধ চুষে খাচ্ছে।
তাঁকে দেখেই উদিপুরীর দুচোখে খুশির ঝলক দেখা দিল। তিনি বললেন, ‘আওরঙ্গজেব আসুন, আপনার ছেলেকে দেখুন। পাতলা কালো চুলের ছোট্ট মাথাটা কোলে ধরে তিনি শিশুটিকে বুক থেকে সরিয়ে নিয়ে আওরঙ্গজেবের দিকে তুলে ধরলেন। দুধ খাওয়া থেকে সরিয়ে নিতেই শিশুটি ছোট ছোট পাগুলো ছুঁড়তে ছুঁড়তে কান্না জুড়ে দিল। আওরঙ্গজেব তাকে কোলে নিলেন।
তিনি উদিপুরীর দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললেন, আমি এর নাম দিতে চাই কম বক্স। মোল্লারা বলেছে এই নামটি শুভ। তুমি খুশি তো এই নামে?
উদিপুরী ঘাড় কাত করে সায় দিলেন।
কম বক্সের ছোট্ট নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকাতেই আওরঙ্গজেব আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন, তার দম বন্ধ হয়ে এল। পৃথিবীর অশুভ কোনো কিছুর ছোঁয়া এই শিশুটির গায়ে এখনও লাগেনি। এই ছেলেটি তার অন্যান্য ভাইদের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, হয়তো–বৃদ্ধবয়সে এই ছেলেই তাঁর অবলম্বন হবে। তবে একমাত্র আল্লাহই জানেন ভবিষ্যতে তার নিজের আর এই শিশুটির কপালে কি লেখা আছে। তবে তিনি প্রার্থনা করলেন যেন কম বক্সের প্রতি তার অনুভূতি সবসময় যেন এরকমই থাকে। ছেলেটি যেন কখনও জানতে না পারে, শীতলতা আর প্রত্যাখ্যানের কষ্ট, যা তিনি নিজে তার বাবার হাতে সহ্য করেছিলেন।
০৫. জাদুকরী রওশনআরা
‘জাঁহাপনা শীঘ্র উঠুন, খাজাসারা–খোঁজা এখুনি আপনার বোন রওশনআরার ঘরে যেতে আপনাকে অনুরোধ করেছেন।
আওরঙ্গজেব টের পেলেন, উদিপুরী তার পাশেই নড়ে উঠলেন। জোর করে দুচোখ খুলে তিনি পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলেন হেরেমের পরিচারক একটা মোমবাতি উঁচু করে ধরে রয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে?
তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, জাঁহাপনা।
‘আমি এখুনি যাচ্ছি।’ তাড়াতাড়ি উঠে, আরেকজন পরিচারকের বাড়িয়ে ধরা আলখাল্লা গায়ে জড়িয়ে তিনি হেরেমের নীরব করিডোরের মধ্য দিয়ে হেঁটে রওশনআরার ঘরের দিকে চললেন। কচ্ছপের খোলের মতো কারুকাজ দরজাটি হাট করে খোলা রয়েছে। ভেতরে জাহানারা, গওহরা আর কয়েকজন মহিলা ভিড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। দুজন পাগড়িপরা হেকিম রওশনআরা যে বিছানায় শুয়ে রয়েছেন, তার উপর ঝুঁকে রয়েছেন। আওরঙ্গজেব সামনে এগোতেই কাঁপা কাঁপা মোমবাতির আলোয় তাঁর দীর্ঘ দেহের ছায়া ফেললো। ভারি কাঁচের চশমাপরা বয়স্ক হেকিমটি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন এবং বুকে এক হাত রেখে তাকে সম্মান জানালেন। আওরঙ্গজেব দেখলেন অন্য কমবয়সি চিকিৎসকটি তার বোনের ডান কব্জির কাছে একটি ইস্পাতের পাত্র ধরে রয়েছেন তাতে উজ্জ্বল লাল ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ধরছেন।