তার বোন তাকে এভাবে দোষারোপ করায় জাহানারা হতভম্ব হয়ে ভাবতে শুরু করলেন। কি করে তিনি তাকে বোঝাবেন যে, এগুলো কোনোটাই তার কাজ নয়? অবশেষে তিনি বললেন, আমার কথা শোন। তুমি নিশ্চিত হয়ে ভেবেছ। যে, আওরঙ্গজবের চোখে আমি তোমাকে খারাপ দেখাতে চাই, তবে আসলে এটা আমি কখনও চাই না। আগ্রা দুর্গে এতগুলো বছর বাবার সেবায় একাকী কাটাবার সময়, শুধু জানি আমার সঙ্গী ছিল। তখন আমি সব সময় আমাদের সেই দিনগুলোর কথা ভাবতাম, যখন আমরা সবাই একসাথে মিলে হাসিখুশি আর আনন্দে দিন কাটাতাম। সেই সময়গুলো আর ফিরে আসবে না, যেমন মৃতও আর জীবিত হয় না। তবে তখন আমি বিশ্বাস করতাম আর এখনও করি যে, এককালে আমরা যেরকম ছিলাম তার কিছুতো উদ্ধার করতে পারি। সেজন্যই আওরঙ্গজেব যখন আমাকে দরবারে আসতে বললো, তখন আমি তার কথায় রাজি হলাম, যদিও আমার কিছুটা সন্দেহ ছিল। আমি আর কোনো বিভক্তি চাই না আমি সমস্ত ক্ষত নিরাময় করতে চাই যাতে, শাহজাহান আর মমতাজের আর যেসব ছেলেমেয়ে আছে তারা যেন একটি পরিবার হয়ে থাকে।
রওশনআরা এখন তার কান্না থামিয়ে একাগ্র হয়ে জাহানারার দিকে তাকাল। এবার একটু সাহস করে জাহানারা আবার রওশনআরার হাত ধরতে চাইলে তিনি বাধা দিলেন না।
‘বোন, আমি আমার মায়ের জীবনের কসম খেয়ে বলছি, আওরঙ্গজেব তোমার সম্বন্ধে যা যা শুনেছে তা আমি বলি নি। তবে এ ধরনের গুজব শোনার পর সে এরকম কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাতে আমি অবাক হইনি। তুমি লক্ষ করনি সে কিরকম বদলে যাচ্ছে? ধর্মীয় বিশ্বাসে সে সবসময় গোঁড়া আর কঠোর নীতিপরায়ণ ছিল, তবে এখন–যা, আমার মনে হচ্ছে সমস্ত দুনিয়াই দেখতে পাচ্ছে–এগুলো আরো কঠোরতা আর সমস্ত কিছু ব্যাপী হচ্ছে। যেটাকেই সে ইসলামের সঠিক পথ মনে করছে, তাতেই সে আরো কঠোরভাবে লেগে থাকছে। আমি বিশ্বাস করি তার ভাবনা ঠিক নয়। আমি তাঁকে বার বার বুঝাতে চেষ্টা করেছি যে, এটা একটা বিপজ্জনক পথ। এটা খুবই সংকীর্ণ, এতে কোনো ধরনের আপস করার সুযোগ নেই আর এটি মানুষের দুর্বলতাকে কোনো ধরনের ছাড় দেবে না। কিন্তু সে আমার কথা শুনেনি–তুমি হয়তো ভেবেছ তার উপর আমার খুব প্রভাব আছে, কিন্তু আসলে তা না। এখন যে সে তোমার উপর এত কঠিন হচ্ছে, এর কারণ তোমার আচরণ সম্পর্কে সে যা শুনেছে, তার মতে এটা আমাদের ধর্মবিশ্বাসের নীতির সাথে খাপ খায় না। তুমি দ্যাখো সে কিভাবে গানবাজনা বাদ দিয়েছে, কারণ সে মনে করে এটা যে আনন্দ দেয় তা আত্মপ্রশ্রয়ী আর সেই কারণে এটা শোনা গুনাহ। তবে এসবের মানে এই নয় যে আওরঙ্গজেব তোমাকে ভালোবাসে না…সে মনে করে সে যা করছে তা তোমার ভালর জন্যই করছে।
জাহানারা তার হাত ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই, রওশনআরা গাল থেকে ঘসে চোখের পানি মুছলেন। তারপর গলায় ঝুলানো একটা রিবন থেকে দামি পাথর বসানো ছোট্ট আয়নাটা নিয়ে মুখ পরীক্ষা করলেন। লেপ্টে যাওয়া সুর্মার দাগ মুছে উঠে দাঁড়ালেন। জাহানারা ভাবলেন, তিনি কি তাঁর বোনকে বুঝাতে পেরেছেন? তবে একটা কথা তাকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করতে হবে। মদ খাওয়া একটা ব্যাপার তবে একজন শাহজাদির গোপন প্রণয়ী নেওয়াটা …তাদের পূর্বপুরুষদের যুগে এ ধরনের ঘটনায় সাথে সাথে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা হত। এমনকি এখনও ধর্মের ব্যাপারে আওরঙ্গজেব যেরকম কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছে, সেক্ষেত্রে কে জানে সে কি করে ফেলবে, যদি হাতে-নাতে রওশনআরাকে পরপুরুষের সাথে অশোভন অবস্থায় ধরে ফেলে? তাঁকে অবশ্যই তার বোনকে সাবধান করতে হবে, তবে কথাগুলো বলার সময় তাকেও বুঝে শুনে বলতে হবে। হয়তো তিনি রওশনআরাকে বুঝাতে পেরেছেন যে, তার ভাই তাঁর সম্পর্কে যা যা শুনেছে, তা জাহানারা বলেন নি, তবে এর মানে এই নয় যে তার প্রতি রওশনআরার বৈরি মনোভাব কেটে গেছে। বিশ্বাস অর্জন তো অনেক দূরের কথা।
‘রওশনআরা, একটা কথা আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করতে চাই। আমার কথায় কিছু মনে করো না, তবে তুমি কিন্তু বলেছে যে, আওরঙ্গজেব গুজব শুনেছে যে তোমার গোপন প্রণয়ী আছে। আচ্ছা…তুমি কি এমন কিছু করেছ যে কারণে লোকে হয়তো ভাবতে পারে যে বিষয়টা আসলেই তাই?’ রওশনআরা তাঁর দিকে তাকালেন তবে কিছুই বললেন না আর জাহানারার মনটা দমে গেল। তিনি আবার বললেন, রওশনআরা–দয়া করে…’
‘দয়া করে কি বলবো? তোমাকে এমন কথা বলবো যা তোমার বিষয় নয়? যদি আমার গোপন প্রেমিক থাকেও–এর মানে বলছি না যে আছে–আর থাকলেই বা কি? মোগল সম্রাটের কন্যারা যেহেতু বিয়ে করতে পারে না, তার মানে এই নয় যে তারা জীবনের আনন্দ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করবে–এরকমভাবে আমার দিকে তাকিও না। তুমি কে বিচার করার? তুমি আর তোমার সেই ইংরেজ–নিকোলাস ব্যালেনটাইনের ব্যাপারটাই বা কি? তুমি তো সবসময় ভাণ করতে যে তুমি একেবারে শুদ্ধ, কিন্তু আমি জানি তুমি করতে। আর সেজন্য আমি বাবাকে কথাটা বলেছিলাম, তবে একারণে নয় যে ব্যাপারটা আমি অনুমোদন করি না। তুমি একজন ভণ্ড-তপস্বী ছিলে, তাই তোমাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম। এখনও যেরকম হয়েছে!
রওশনআরা তুমি বুঝতে পারছে না…আমি এখানে কোন বিচার করতে বসি নি, আমি শুধু তোমাকে সাহায্য করতে চাচ্ছি। তোমাকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে…’।