‘এমন ভাণ দেখাচ্ছ যেন তুমি কিছুই জানো না!’
‘সত্যি, আমি জানি না…বল না তোমার কি হয়েছে?
রওশনআরা তার কোমরবন্ধে গুঁজে রাখা ভাঁজ করা একটি কাগজ টেনে বের করে বললেন, এটা! এটাই হল ব্যাপারটা!
‘কি এটা?
ভাবাবেগে কাঁপতে কাঁপতে তিক্তকণ্ঠে রওশনআরা বললেন, আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে পাওয়া একটা চিঠি…সব দোষ তোমার! আমি জানি তার উপর তোমার কিরকম প্রভাব আছে। সে তোমাকে দাম দেয় আর শুধু তোমার কথা শুনে, কিন্তু তোমার কি দরকার ছিল তোমার পদবী ব্যবহার করে আমার ব্যাপারে নাক গলাবার? এখন এমন নির্দোষ সাজার চেষ্টা করো না। আমাকে তুমি বোকা বানাতে পারবে না। আমি ঠিক জানি তুমি কি করেছ… আওরঙ্গজেবকে আমার সম্বন্ধে নানারকম গল্প বলেছ।
‘তুমি কি বলছো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
“জানো না? আওরঙ্গজেব যখন তোমাকে দরবারে ফিরিয়ে নিয়ে এল আর তুমি আমার জায়গাটা দখল করে পাদিশাহ বেগম হলে, একবারও আমার কথা ভাবলে না যে, আমি কি ভাবতে পারি…আমি…’
রওশনআরা, আমি জানি এটা তোমার জন্য কষ্টকর হয়েছিল। বিষয়টা নিয়ে আমার উচিত ছিল তোমার সাথে আরো কথা বলা, কিন্তু আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি যে কি বলবো, সত্যি বলতে কি আমি বেশ অস্বস্তি বোধ করছিলাম। আর একই সাথে কখনও ভাবিনি যে তুমি এতটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বে।’
রওশনআরা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কেন এটা হয়েছিল? আমি বলছি শোন! তুমি ধরে নিয়েছিলে, যেরকম দারাও সবসময় মনে করতেন যে, সবার বড় হওয়ার কারণে সমস্ত সম্মান তোমার প্রাপ্য আর বাকি আমাদের সাথে ছোট বাচ্চা মনে করে সেরকম ব্যবহার করবে, যখন ইচ্ছা একটু খাতির করবে…’।
ভাইয়ের কথা বলতেই জাহানারা অন্যদিকে মুখ ফেরালেন, যাতে তার বোন তার চেহারায় কষ্ট আর রাগ দেখতে না পায়। আওরঙ্গজেবের উত্থানকে রওশনআরা যেভাবে বর্ণনা করছিল, তাতে মনে হচ্ছিল এটা ভ্রাতৃঘাতী লড়াই নয়, যা রক্তপাত আর মৃত্যু ঘটিয়েছিল বরং এটা বাচ্চাদের একটা ঝগড়া। রওশনআরা সবকিছুকে একটা সংকীর্ণ, আত্মকেন্দ্রিক দৃষ্টিতে বিচার করতেন– হয়তো এছাড়া তার আর উপায় ছিল না, তাছাড়া তিনি স্পষ্টতই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আছেন। নিজের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণে এনে জাহানারা তার বোনের কাছে হাটুগেড়ে বসে তার হাত ধরার চেষ্টা করলেন, তবে রওশনআরা তার দুহাত শক্ত করে নিজের কোলে ভাঁজ করে রাখলেন।
জাহানারা শান্তস্বরে বললেন, ‘যত ইচ্ছা আমার সমালোচনা কর, তবে দারাকে নয়। তিনি এখন মৃত আর তুমি জান তিনি আমাকে কতটা আপন ভাবতেন…’ তারপর বলতে চাচ্ছিলেন, তোমাকেও তাই ভাবার কথা; কেননা তিনি তোমারও ভাই ছিলেন, কিন্তু তার বদলে বললেন, ‘এখন বলতো, একটু আগে যে আমাকে দোষ দিলে, আমি তোমার ব্যাপারে নাক গলিয়েছি, একথাটার মানে কি?
‘আওরঙ্গজেব অভিযানে যাওয়ার ঠিক আগে আমি তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তুমি জানো নিশ্চয়ই সেটা।
না জানি না, তারপর বল।
‘আমি তাকে বলেছিলাম আমার পদবী কেড়ে নিয়ে সে আমার মনে কতটা কষ্ট দিয়েছে। সে বললো সে সেটা বুঝতে পেরেছে…তাই সে আর তুমি দুজনে মিলে আমার জন্য অন্য কোনো দায়িত্ব দেবে…সে আমাকে মূল্য দেয় আর আমাকে ভালোবাসে। আমি তার কথা বিশ্বাস করেছিলাম, কিন্তু এখন দেখলাম কথাগুলো সে আসলে সেই অর্থে বলেনি…কোনোটাই না!’ রওশনআরার কপালে একটা শিরা দপদপ করতে লাগলো, চোখে পানি এসে গেছে।
‘কেন নয়?
কারণ তাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার মতো দুর্গের ভেতরে আমিও একটা মহল পেতে পারি কি-না। সে কথা দিয়েছিল বিষয়টা বিবেচনা করবে…এমনকি এও বলেছিল কোনটা আমার জন্য ভালো হবে…তারপর দ্যাখো আজ একজন সংবাদবাহক এই চিঠিটা নিয়ে এসেছে, যাতে আওরঙ্গজেব লিখেছে সে আমার কথা রাখতে পারবে না। তোমার মতো আমাকে নিজস্ব আলাদা মহল দিয়ে সে আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে নাকি খবর পেয়েছে যখন সে দূরে ছিল, তখন আমি মদের আসর বসিয়েছিলাম। আরো জানাল বেশ কিছুদিন আগে থেকে সে জানতো যে আমি মদ খাই–তবে এ বিষয়ে সে চোখ বুজে রাখতে চেয়েছিল, তবে ইদানীং আমার বাড়াবাড়ি করার খবর পেয়েছে–একদিন না-কি আমাকে বেঁহুশ অবস্থায় বিছানায় বয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল আর এতেই সে সিদ্ধান্ত বদলেছে। সে আমাকে মদ খেতে সম্পূর্ণ নিষেধ করেছে আর বলেছে, আমি যেন কখনও আলাদা মহলের জন্য আর তাকে অনুরোধ না করি! কিন্তু সবচেয়ে খারাপ যে বিষয়টা তা হচ্ছে …’
দাসিরা সবাই কামরা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল আর ওরা একা ছিলেন। তারপরও রওশনআরা গলা নামিয়ে কথা বলছিলেন আর জাহানারা তার খুব কাছে এসে কথাগুলো শুনছিলেন। সে বললো, সে না-কি শুনেছে আমার গোপন প্রেমিক আছে। সে আমাকে সতর্ক করে বললো, যদি কেউ তাকে এর প্রমাণ দিতে পারে তাহলে ভয়াবহ পরিণতি হবে আর আমাকে জানাল, সে আমার কয়েকজন চাকরকে সরিয়ে দিয়ে তার বিশ্বস্ত লোকদের সে জায়গায় বহাল করবে, যারা তাকে আমার সমস্ত গতিবিধির খবরাখবর তাকে জানাবে। এটা অনেকটা কারাগারের মতো হয়ে দাঁড়াবে আর এর সবকিছু তোমার কীর্তি। তুমি আমাকে শাস্তি দিতে চাও, কেননা আমি তোমার পক্ষে দাঁড়াই নি। তুমি আসার আগে আওরঙ্গজেব আমাকে বিশ্বাস করতো…আমার উপর নির্ভর করতো …আর এখন সবকিছু বদলে গেছে। রওশনআরা এখন ফিসফিস করা ছেড়ে কর্কশকণ্ঠে জাহানারাকে দোষারোপ করে কথা বলছিলেন। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আওরঙ্গজেব যখন ফিরে আসবে, তখন তুমি তার কাছে গিয়ে বলবে যে, তুমি যা বলেছে তা সত্যি নয়…কোনোটাই নয়!