আওরঙ্গজেবের বাম হাত আর দুই আঙুলের ফাঁক দিয়ে টপ টপ করে রক্ত ঝরে পড়তে লাগলো। এদিকে তাঁর দুই সৈনিক গোকলাকে দুদিক থেকে শক্ত করে চেপে ধরলো, তারপরও সে ছাড়া পাওয়ার জন্য ধস্তাধস্তি করতে লাগলো। তিনি ওদেরকে বললেন, তাকে মেরে ফেলো না। পেছনে নিয়ে যাও। বিজয় নিশ্চিত করার পর আমি তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেব। তাকে বন্দী করার খবর একবার ছড়িয়ে পড়লে আমাদের কাজ সহজ হয়ে যাবে। একজন সেনা কর্মকর্তা তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘জাহাপনা, আপনার হাত কেটে গেছে, একটু অপেক্ষা করলে হত না, যাতে হাকিম ক্ষতস্থানটা পরিষ্কার করে একটা পট্টি বেঁধে দিতে পারেন।’
না, সামান্য ছড়ে গেছে। তার চেয়ে বরং ওদের নেতা ধরা পড়ার পর ওদের মাঝে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, সে সুযোগটা এখন আমাদের নিতে হবে। ঘণ্টা দুয়েক পর সূর্য যখন মধ্যগগনে এসেছে আর বাতাস মাটি থেকে লাল ধুলি উড়িয়ে নিচ্ছিল, তখন দুইজন সিপাহি গোকলাকে ঠেলে নিয়ে এসে আওরঙ্গজেবের সামনে নতজানু করে বসালো। তিনি একটু দূরে সর্বাধিনায়কের লাল টকটকে তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। হাতমুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে তিনি রাজকীয় আলখাল্লা পরেছেন আর হাকিম তার হাতের ক্ষতস্থান সেলাই করে নিখুঁতভাবে পট্টি বেঁধে দিয়েছিলেন। অবশ্যই তিনি ঠিক বলেছিলেন। গোকলা বন্দী হবার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে তার বেশিরভাগ সেনা লড়াই থামিয়ে পালিয়ে যেতে শুরু করলো। তবে পালবার সময়ও ওরা শৃঙ্খলা বজায় রেখেছিল। আওরঙ্গজেব হতাশ হয়ে দেখলেন অধিকাংশ জাট সেনাই পালিয়ে গেছে, তিনি যে আশা করেছিলেন, দ্বিতীয় আরেকজনের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে ওরা আবার আক্রমণে ফিরে আসবে, তা আর হল না। তিনি তাঁর সৈন্যদের বললেন, জাটদের ধাওয়া করতে আর কোনো গ্রামবাসী যদি পলাতক কোনো জাট সেনা আশ্রয় দেয়, তবে পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে যেন আর কেউ তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সাহস না পায়।
আওরঙ্গজেব এবার গোকলার দিকে ফিরে বললেন, তুমি কেন আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলে সে সম্পর্কে তোমার সম্রাটকে তোমার কিছু বলার আছে? গোকলা তার ক্ষতবিক্ষত মুখ তুললো। তার বাহারি মোচ রক্ত মেখে জট পাকিয়ে গেছে তবে চাউনিতে এখনও নিঃশঙ্ক স্পর্ধা দেখা যাচ্ছে। সে বললো, ‘আপনি আমাদের জীবন আর এখন আমাদের ধর্মের উপর যে অত্যাচার অনাচার চালাচ্ছেন, তা থেকে আমার দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য আমি যা করণীয় করেছি। জাটদেরকে আপনার শাসন করার অধিকার আমরা স্বীকার করি না। আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল আপনাকে হত্যা করা। সেজন্য সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি আমার লোকদেরকে পিছু হটতে দেই নি আর সেজন্যই আমি সামনে এগোই। আমার কাছে আপনি অশুভের একটি প্রতিমূর্তি। যদি পৃথিবী থেকে আপনাকে সরিয়ে দিতে পারতাম, তবে আমার জীবনের বেঁচে থাকা সার্থক হত। তবে আমার একমাত্র গভীর দুঃখ যে, আমি ব্যর্থ হয়েছি।’ কথাগুলো বলার পর গোকলা দাঁড়াতে চেষ্টা করলো, তবে দুই প্রহরী তাকে আবার ঠেলে নিচে চেপে ধরলো।
আওরঙ্গজেব অতিকষ্টে রাগ সামলালেন। একজন সম্রাট হিসেবে একজন পরাজিত বিদ্রোহীর সাথে আর বেশিক্ষণ কথা বলাটা শোভা পায় না। সেরকম কিছু করার অর্থ গোকলা আর তার ঘৃণাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যা হওয়াটা ঠিক হবে না। তিনি বললেন, আমি নই, তুমি এখন মরবে। তোমার বিশ্বাসঘাতক দেহের প্রতিটি অঙ্গ আলাদা আলাদা করে কেটে টুকরোগুলো আগ্রা শহরের ফটকে ঝুলিয়ে রাখা হবে। তারপর তার পেছনে দাঁড়ান দেহরক্ষীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এখুনি তাকে কোতল করার ব্যবস্থা কর। আর আমার নির্দেশ মতো সাথে সাথে তার দেহটির ব্যবস্থা নিতে বলবে। এই সাধারণ বিশ্বাসঘাতককে নিয়ে আমি আর সময় নষ্ট করতে চাই না, যতই সে উদ্ধত হোক।
এইকথা বলে সম্রাট ধীরে ধীরে হেঁটে তার লাল তাবুর দিকে ফিরে গেলেন, একবারও পেছন ফিরে গোকলার দিকে তাকালেন না। তাকে তখন প্রহরীরা টেনে নিয়ে যাচ্ছিল কোতল করার জন্য আর সে চিৎকার করে ছাড়া পাওয়ার জন্য ধস্তাধস্তি করতে লাগলো। আওরঙ্গজেব মন শান্ত হওয়ার পর ভাবলেন, বিজয়লাভের জন্য তাকে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করতে হবে। তারপর তাঁকে ভাবতে হবে কিভাবে অন্য ভয়ঙ্কর বিদ্রোহী শিবাজিকে ধরা যায়।
*
রওশনআরা, তোমাকে দেখে খুব খুশি হলাম। আজকাল তোমার দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না।’ জাহানারা ভাবলেন, সে নিশ্চয়ই শুনেছে আওরঙ্গজেব জাটদের পরাজিত করেছেন আর শীঘ্রই দিল্লি ফিরে আসছেন। তবে রওশনআরাকে দেখে খুব একটা খুশি মনে হল না। রঞ্জক দিয়ে লাল করা তার পাতলা ঠোঁটের রেখা আর চেহারা দেখে মনে হল বেশ চাপে রয়েছেন আর কোনো বিষয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছেন। জাহানারার পরিচারিকা তাকে একটা মিষ্টি খেতে সাধলেও তিনি হাত নেড়ে মানা করলেন। তারপর বসে চারপাশে তাকিয়ে বললেন, “তোমার ঘরটাতো আগের চেয়ে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। দেয়ালে ঝুলানো ঐ রেশমি পর্দাগুলো নতুন, তাই না? অবশ্য আওরঙ্গজেব তোমাকে সবচেয়ে ভালো জিনিস ছাড়া অন্য কিছু নিতে দেবেন না, তাই না? কথাটা বলতে গিয়ে তার গলার স্বর ভেঙ্গে যাচ্ছিল।
রওশনআরা, তোমার কি হয়েছে বলতো?