লড়াইয়ের ময়দানের সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থা কোথায় তা দেখতে গিয়ে আওরঙ্গজেবের হৃতস্পন্দন বেড়ে গেল। তবে তিনি অবিচল থাকার চেষ্টা করলেন, ধীরস্থিরভাবে নড়াচড়া করলেন, কোন ধরনের অস্থিরতা প্রকাশ করলেন না, যাতে তার হাবভাব দেখে তার চারপাশের সৈন্যরা ঘাবড়ে না যায়। তাৎক্ষণিক বিপদটি টের পেলেন যখন দেখলেন কমলা রঙের রণবেশে একদল জাট অশ্বারোহী সেনা সংঘবদ্ধ হয়ে দ্রুত তার দিকেই এগিয়ে আসছে। এদের ঠিক মাঝখানে দুজন পতাকাবাহি সৈন্য বড় একটি কমলা রঙের পতাকা জোর হাওয়ায় পেছনে হেলে যাওয়া থেকে ধরে রাখার চেষ্ট করছে। লক্ষ করলেন এদের মাঝে ভারি গোঁফওয়ালা একজন লোক তাঁকে দেখিয়ে ইশারা করছে। এই লোক জাটদের নেতা গোকলা ছাড়া আর কেউ নয়।
হঠাৎ প্রথম সারির দুজন জাট অশ্বারোহী ঘোড়ার পাদানিতে দাঁড়িয়ে ওদের লম্বা নলের গাদা বন্দুক তার দিকে তাক করলো। ওরা গুলি ছুঁড়তেই তিনি সাদা ধোঁয়া বেরুতে দেখলেন, তবে তিনি নড়াচড়া না করেই স্থির রইলেন, কেননা তিনি জানতেন তিনি ওদের বন্দুকের পাল্লা থেকে অনেক দূরে রয়েছেন। যুদ্ধের হট্টগোলের মধ্যে তিনি তাঁর হাতির কাঁধে বসা দুই মাহুতের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললেন, ‘সামনে চল।’ দুই মাহুতের মধ্যে পাকা চুলের বয়স্ক লোকটির সারা মুখ বসন্তের দাগে ভরা ছিল। সে আংকা–একটি ইস্পাতের দণ্ড দিয়ে হাতিটির গায়ে খোঁচা মেরে নিচু পাহাড় থেকে নেমে সমতলভূমিতে লড়াইয়ের ময়দানের দিকে নিয়ে চললো। শুড় তুলে হাতিটি উচচনাদ করে ঢাল বেয়ে নিচের দিকে নামতে শুরু করলো। পাহাড়ের পাদদেশে নামতেই তাঁর অশ্বারোহী দেহরক্ষীবাহিনীর সদস্যরাও তার চারপাশে কাছাকাছি অবস্থান নিল। তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘সমস্ত বিজয় পতাকা উড়িয়ে দাও আর শিঙ্গা আর নাকাড়াবাদকদের আক্রমণের ইঙ্গিতসূচক নাকাড়া আর ভেরী বাজাতে বল। আমি আমার সৈন্যদের দেখাতে চাই যে, আমি শত্রুদের মোকাবেলা করার জন্য সামনে এগোচ্ছি। এতে তাদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে। সবুজ পতাকাগুলো মেলে ধরতেই বাতাসে পতপত করে উড়তে শুরু করলো। সাথে সাথে ভেরী বেজে উঠলো আর শান্ত ঘোড়ার পিঠের দুইপাশে ঝুলানো শক্ত উঁটের চামড়ার ঢোলকের উপর দ্রুত কাঠির ঘা পড়তেই যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো।
আওরঙ্গজেব তাঁর দেহরক্ষীদল নিয়ে গোকলার অশ্বারোহীদলটির দিকে এগোতে লাগলেন। তারপর আরেকজন জাট সেনা পাদানিতে দাঁড়িয়ে তার গাদা বন্দুক তাক করলো। এবার ওরা বন্দুকের পাল্লার মধ্যে ছিল। পাকাচুলো মাহুতটি শরীর মুচড়ে আওরঙ্গজেবের হাতির কাঁধ থেকে সামনের দিকে পড়ে গেল। তার সারা মুখ রক্তাক্ত হয়ে গেল। দীর্ঘদিনের মাহুত মাটিতে পড়ে যেতেই হাতিটি একপাশে হেলে তার উপর পা ফেলা এড়াল। এতে হাওদাটি ভীষণভাবে দুলে উঠতেই আওরঙ্গজেব দুই হাতে হাওদার দুই ধার আঁকড়ে ধরে মাটিতে পড়ে যাওয়া সামলালেন। প্রায় সাথে সাথে দ্বিতীয় মাহুত প্রথম মাহুতের জায়গায় বসে হাতিটিকে স্থির করলো।
আওরঙ্গজেব তার পেছনে বসা খানসামাকে বললেন, শিগগির আমাকে একটা বন্দুক দাও।’ লোকটি সাথে সাথে তাঁর হাতে একটি বন্দুক তুলে দিল। হাতির দাঁতের নকশা করা বাঁট শক্ত করে ধরে বেশ সাবধানে তিনি গোকলার দিকে লক্ষ স্থির করলেন। সে তখন তার বাঁকা তরোয়াল দিয়ে একজন মোগল দেহরক্ষী সেনার উপর কোপ মেরে চলছিল। আওরঙ্গজেব গুলি ছুঁড়তেই তাঁর দেহরক্ষীর ঘোড়াটি পেছনের দিকে লাফ দিতেই এর আরোহী মাটিতে পড়ে গেল। মাটিতে পড়ার আগে গোকলার তরোয়ালের আঘাতে সে আহত হল। আওরঙ্গজেবের গোলাটি গোকলাকে আঘাত না করলেও এটি পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ান আরেকটি ঘোড়ার মাথায় আঘাত করলো। সাথে সাথে ঘোড়াটি তার আহত আরোহীকে পিঠে নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। গোকলা তার ঘোড়ার রাশ টেনে ধরে মাটিতে পড়ে পা ছুঁড়তে থাকা ঘোড়াটি এড়ালো, তারপর আওরঙ্গজেবের হাতির দিকে ঘোড়া ছুটাল। কঠোর চেহারার কয়েকজন জাট সেনা মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তাকে অনুসরণ করলো।
আওরঙ্গজেব আবার খানসামাকে বললেন, তাড়াতাড়ি আমার আরেকটা বন্দুক দাও।’ লোকটি দ্রুত দ্বিতীয় বন্দুকটি তার হাতে তুলে দিতেই তিনি আবার এর লম্বা নল বরাবর সতর্কতার সাথে লক্ষ্যস্থির করলেন। এমনসময় তার হাতিটি মাটিতে পড়ে থাকা একটি মানুষের দেহের সাথে হোঁচট খেতেই আওরঙ্গজেবের ছোঁড়া গোলাটি এবার গোকলার কালো ঘোড়াটির ঘামে ভেঁজা দেহে আঘাত করলো। ঘোড়াটি মাটিতে পড়তেই গোকলা এক লাফে ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে নামলো। মোগলদের তরোয়াল আর বন্দুকের হামলায় সে তার সমস্ত সঙ্গী হারিয়েছে। মাটিতে নেমেই সে তার কমলা রঙের আলখাল্লা উড়িয়ে বাঁকা তরোয়াল হাতে সামনের দিকে ছুটে চললো। লক্ষ্যবস্তু থেকে সে একশো ফুটের মধ্যে পৌঁছতেই আওরঙ্গজেব তাঁর রত্নখচিত খাপ থেকে তরোয়াল বের করলেন। ঠিক তখনই তার একজন দেহরক্ষী উজবেক সেনা ঘোড়ার পিঠ থেকে জাট নেতার উপর লাফিয়ে পড়লো। গোকলার হাত থেকে তরোয়াল পড়ে গেল আর মোগল সেনাটি তাকে টেনে মাটিতে ফেললো।
কয়েকমুহূর্ত লোকদুটো মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে সুযোগমতো আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছিল। তারপর একসময় গোকলা তার কোমরের খাপ থেকে ছোরা বের করে উজবেক সেনাটির কুঁচকির গভীরে ঢুকিয়ে দিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতেই লোকটা কেঁপে উঠে দুই হাতে ক্ষতস্থান চেপে ধরলো। গোকলা কোনোমতে উঠে দাঁড়াল। চারপাশে তাকিয়ে সে বুঝলো সে এখন একা এবং শীঘ্রই তাকে মেরে ফেলা কিংবা বন্দী করা হবে। জাট নেতা হাত পেছনে দুলিয়ে হাতের ছোরাটি সোজা আওরঙ্গজেবের দিকে ছুঁড়ে মারলো। তার নিশানা খুব ভাল ছিল। ডগা উল্টিয়ে ছুরিটি সোজা উড়ে গেল, এবার আওরঙ্গজেব শরীরে একটা মোচড় দিয়ে সরে গেলেন। তারপরও ছুরিটি তাঁর বামকনুইয়ের নিচের অংশ ঘেসে পিছলে গেল। হাওদার একপাশে কাঠের কিনারায় ধপ করে বসে পড়ার আগে তিনি বাম হাতটি উঁচু করে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছিলেন।