আধখানা চাঁদের বেমানান আলোয় তার সেনা কর্মকর্তারা ঘোড়ায় চড়ে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করছিল, তাদের দিকে লক্ষ করতে করতে তিনি ভাবছিলেন এই সুযোগে জাটদের আক্রমণ করার আশংকা নেই, কেননা ওরা এখনও অনেক দূরে রয়েছে। তবে সেনাবাহিনী নিয়ে তার এগিয়ে যেতে দেরি হওয়ার সুযোগটা নিয়ে ওরা সমস্ত লুণ্ঠিত মালামাল নিয়ে অনেক দূরের জঙ্গল আর মথুরা আর রাজপুতনার মাঝের মরুভূমিতে হারিয়ে যাবে। তবে ওরা যায় নি। ওদের নেতা গোকলা মোগল নগররক্ষী বাহিনী আর কোষাগারের উপর হামলা চালিয়েই চললো। তারপর আগ্রা থেকে আওরঙ্গজেব যে সেনাদলটি পাঠিয়েছিলেন, তাদেরকে কৌশলে এড়িয়ে গোকলা সরাসরি সম্রাটের মুখোমুখি হয়ে যুদ্ধ করার ঔদ্ধত্য দেখিয়ে সামনে এগোতে শুরু করলো।
পরিকল্পনা মাফিক তাঁর নিজের সেনাসংখ্যা শত্রুর চারগুণ না হলেও, লড়াই আসন্ন হতেই আওরঙ্গজেব নিশ্চিত হলেন যে তাঁর কাছে এখনও যে পরিমাণ সৈন্য রয়েছে, তা গোকলাকে তার হঠকারিতার জন্য অনুতপ্ত হতে বাধ্য করবে। তাঁর হাতির কাছে দাঁড়ান দুজন সেনাকে তিনি চিৎকার করে নির্দেশ দিলেন, আমার সেনাপতিদের কাছে যাও। ওদেরকে বল জাটদের আক্রমণ মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হতে। সামনের সারিতে অশ্বারোহীদল রাখতে বল, যাতে ওদের ঠিক পেছনে আমাদের শ্রেষ্ঠ গাদা বন্দুকধারী সেনাদলটিকে ওরা ঢেকে রাখে। আর সেই সাথে আমাদের সাথে আনা কামানগুলোও সাজাতে বল। জাটরা আক্রমণে সামনে এলেই আমাদের অশ্বারোহীদলটি দুই পাশে সরে গিয়ে শত্রুদেরকে আমাদের বন্দুকধারী সেনা আর গোলন্দাজদের মুখোমুখি করবে। তারপর শত্রুসেনার আক্রমণ যখন ভোতা হয়ে যাবে আর ওরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে, তখন অশ্বারোহীবাহিনী ওদের উপর চড়াও হয়ে ওদেরকে কচুকাটা করবে। আমি ঐ নিচু টিলার উপর থেকে যুদ্ধের গতিবিধি লক্ষ করবো। ইনশাল্লাহ, আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন আর আমরা জয়ী হব।’
প্রায় আধাঘণ্টা পর আওরঙ্গজেব তার পছন্দের জায়গা থেকে লক্ষ করলেন উন্মুক্ত জাট আশ্বারোহীসেনার প্রথম দলটি রণহুঙ্কার দিতে দিতে দ্রুতবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে মাথা নিচু করে বর্শা বাগিয়ে এল। তাঁর নির্দেশমত বন্দুকধারী আর গোলন্দাজবাহিনীকে ঢেকে রাখা সামনের সারির মোগল অশ্বারোহী সেনাদলটির দিকে ওরা ছুটে এল। আবার তাঁর নির্দেশ মোতাবেক একেবারে শেষ মুহূর্তে মোগল অশ্বারোহীরা ডানে আর বামে ঘোড়া নিয়ে সরে গেল। ওরা সরে যাওয়ার সাথে সাথে তাঁর নির্দেশ অনুসরণ করে দ্বিতীয় সারির সেনারা গাদা বন্দুক আর কামানের গোলা ছুঁড়তে শুরু করলো। রণক্ষেত্র গাদা বন্দুকের পট পট আর কামানের প্রচণ্ড শব্দে ভরে গেল। একদুই মিনিট সাদা ধোঁয়ায় তিনি কিছুই দেখতে পারলেন না, অথচ তার মনে হচ্ছিল যেন অনেকক্ষণ ধরে এটা হচ্ছিল। হঠাৎ মৃদু হাওয়ায় ধোয়ার পর্দাটা পাতলা হয়ে যেতেই, তিনি দেখলেন অনেক জাট অশ্বারোহীসেনা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রয়েছে। আরোহীবিহীন ঘোড়াগুলো দ্রুত ছুটে পালাচ্ছিল। আহত ঘোড়াগুলো মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে কিংবা তাদের সওয়ারিদের মতো ভাঙ্গা পা নিয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে।
তার নিজের মোগল অশ্বারোহীসেনাদের সবুজ পোশাকে চেনা যাচ্ছিল। ওরা আবার এই এলোমেলো লড়াইয়ে ছুটে ফিরে এসে শত্রুসেনাদের উপর এলোপাতাড়ি তরোয়ালের কোপ চালাতে লাগলো। তবে ওরা কোনোভাবেই বেশি সুবিধা করতে পারছিল না। জাটদের বেপরোয়া আক্রমণের তীব্রতা এত প্রবল ছিল যে, ওরা মোগল বন্দুকধারী আর গোলন্দাজদের সারির কয়েক জায়গা ভেদ করে ভেতরে ঢুকে পড়লো। এরপর জাটরা কাস্তে দিয়ে কাটার মতো করে কেটে মোগল বন্দুকধারীদের একটি সারির সৈন্যদেরকে রক্তাক্ত করে মাটিতে ফেলে দিল। তা সত্ত্বেও অন্য বন্দুকধারীরা উত্তেজিত হয়ে ইস্পাতের লম্বা দণ্ড দিয়ে তাদের বন্দুকে বারুদ আর গোলা ঢুকিয়ে আবার গুলি ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুত হল। আবার কোথাও কোথাও জাট অশ্বারোহীদের তাড়া খেয়ে কিছু কিছু বন্দুকধারী অস্ত্র ফেলে দিয়ে পেছনের দিকে ঘুরে ছুটে পালাতে লাগলো। এ দৃশ্যটি দেখে তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। লক্ষ করলেন পালাতে গিয়ে একজন বন্দুকধারী হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল, তারপর সে আবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই একজন জাট তার বর্শা দিয়ে তাকে গেঁথে ফেললো, উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে এই কাপুরুষের। তবে পদাতিক সেনারা কেন এটা বুঝতে পারে না যে, জ্বলন্ত চুল্লিতে ফেলা পাখির মত বর্শার ডগা দিয়ে অশ্বারোহী শত্রুরা তাদের বিদ্ধ করবে এই ভয়ে দুই হাত তুলে আতঙ্কে চিৎকার করতে করতে প্রাণ ভয়ে পালানোর চেয়ে ওরা যদি একসাথে দাঁড়িয়ে অশ্বারোহীদের মোকাবেলা করতো তাতে ওদের জীবনের উপর তেমন ঝুঁকি ছিল না, বরং এতে সম্মান ছিল।
শুধু বন্দুকধারীই ছত্রভঙ্গ হয়নি, জাটরা গোলন্দাজ বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কয়েকজন গোলন্দাজ সেনাকে মেরে কয়েকটি কামানও দখলে নিল। কয়েকজন শত্রু সেনা ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে সাথে আনা দড়ি দিয়ে কামানের নলের সাথে বেঁধে কামানের মুখ উল্টোদিকে ঘুরিয়ে মোগল সেনাদের দিকে কামান দাগার চেষ্টা করতে লাগলো। এত দ্রুত কেমন করে এত জাট সৈন্য তার সেনাদের মধ্যে ঢুকতে পারলো? সম্ভবত ওরা একটি ঘোড়ার পিঠে দুজন করে সওয়ার হয়েছিল। যুদ্ধে সফল হবে এই ভেবে জাটরা দড়িসহ এসেছিল যাতে কামানগুলো হস্তগত করতে পারে।