তিনি খুশি হয়ে দেখলেন যে, জাহানারা শোকের পোশাক খুলে অন্য পোশাক পরেছেন। গাঢ়নীল পোশাক পরে তিনি কনের একপাশে একটি কুশনে বসে রয়েছেন। আর আওরঙ্গজেবের মেয়ে জেবুন্নিসা আর তাঁর ছোট বোন গওহারা আরেক পাশে বসে রয়েছে। জাহানারাকে দেখে মনে হল তিনি খোশমেজাজেই আছেন, জেবুন্নিসা কিছু একটা বলে উঠতেই তিনি হেসে উঠলেন। তবে রওশনআরা কোথায়? তিনি চারপাশে চোখ বুলালেন, কিন্তু কোথাও তাকে দেখা গেল না।
তাকে দেখেই লজ্জাবনত জানি ঘোমটাটা আরেকটু টেনে নামিয়ে দিল, তবে তিনি এগোতেই জাহানারা বললেন, তোমার শ্বশুরের সামনে তোমার মুখ ঢাকার দরকার নেই। একথার পর জানি ধীরে ধীরে সোনালি রঙের পাতলা রেশমি ঘোমটাটি ঠেলে সরিয়ে তার দিকে তাকাল। একেবারে দারার মতো দেখতে, সেই একই ডিম্বাকৃতি মুখ, একই রকম ঘন আর কালো চোখ, মসৃণ কপোল, যা তার ভাইয়ের বেলায় বেশ মেয়েলি মনে হত। কি ভাবছিল মেয়েটি? তিনি যে উদারতা দেখিয়ে স্বামী হিসেবে তাকে একজন শাহাজাদাকে দিচ্ছেন, এজন্য কি সে তার সঠিক মূল্যায়ন করছে, নাকি সে তার বাবার চরম পরিণতির কথা স্মরণ করছে? জাহানারা হয়তো তাকে বলেছেন অতীতকে ভুলে গিয়ে সবকিছু ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে, যা তিনি নিজেই করেছেন। আর বর্তমানে যা হচ্ছে তার জন্য কৃতজ্ঞ হতে।
তিনি জানির দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললেন, ‘জানি, আমি তোমাকে আমার মেয়ে হিসেবে স্বাগত জানাচ্ছি। ইনশাল্লাহ আমার ছেলের সাথে তোমার বিয়েতে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে আর তোমরা এই বিয়েকে ফলপ্রসূ করে তুলবে।
‘ধন্যবাদ, জাহাপনা।
‘এই উপলক্ষে আমি তোমাকে, আমার বোন আর মেয়েদের সবাইকে উপহার হিসেবে দেবার জন্য রাজকোষাগার থেকে নিজ হাতে বাছাই করে কিছু রত্ন এনেছি।’ তিনি ঘাড় কাত করতেই পাঁচজন বাদি, প্রত্যেকে একটি করে চামড়ার কাসকেট বয়ে নিয়ে এল। গম্বুজ আকৃতির ঢাকনি খুলতেই ভেতরে হীরা, রুবি, পান্না আর সমুদ্রনীল নীলকান্তমণি ঝলমল করে উঠলো। একটা কাসকেট একটু বড় ছিল–সেটা নববধূর জন্য আর অন্যগুলো তার বোন আর মেয়েদের জন্য। তবে একজন বোনকে সেখানে দেখা যাচ্ছে না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, রওশনআরা কোথায়?
গওহরা উত্তর দিল, ‘বিয়ে পড়ানোর সময় তিনি বলেছিলেন, তাঁর মাথা ধরেছে– আর তাই তাঁর ঘরে ফিরে যাচ্ছেন।
‘আমি নিশ্চিত মাথাধরার কথা ভুলে গিয়ে হাকিম তাকে আমাদের সাথে যোগ দিতে বলবেন, তাহলে তা নিরাময় হবে। একজন নোকর পাঠিয়ে তাকে জানাও যে আমি অনুরোধ করেছি তিনি যেন এখুনি এখানে চলে আসেন, আমি তার আসা পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করছি।’
আওরঙ্গজেব জাহানারার পাশে বসলেন। ওদের চারপাশে মহিলারা নিজেদের মধ্যে মৃদুকণ্ঠে কথা বলছিলেন, কেউ কেউ সামনে এগিয়ে নববধূ আর শাহজাদিদের উপহারগুলো দেখছিলেন। জুই ফুলের মিষ্টি সুবাস উদিপুরী মহলের কথা মনে করিয়ে দিল। তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী হেরেমের অন্যান্য মহিলাদের সাথে এখানে আসতে পারেন নি, তবে তিনিও এই বিয়ে উপলক্ষে তার কাছ থেকে উপহার পাবেন। আওরঙ্গজেব নিজ হাতে তার সুন্দর আসন্নপ্রসবা দেহ রত্নালঙ্কার দিয়ে সাজিয়ে দেবেন…এমন সময় হঠাৎ তাবুর পুরুষমহলের দিক থেকে লোকজনের উচ্চকণ্ঠের আওয়াজ শোনা গেল। পার্টিশনের অপর পাশ থেকে তার খানসামা বললো, জাহাপনা, জরুরি সংবাদ এসেছে।
আওরঙ্গজেব দ্রুত মেয়েমহল থেকে বের হয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী। খবর?’
‘একজন কাসিদ-সংবাদবাহক এই মাত্র ঘোড়ায় চড়ে এসেছে। প্রায় বিশ হাজার জাট সেনা মথুরা আক্রমণ করে চারদিকে লুটপাট চালাচ্ছে।
মথুরা এখান থেকে আগ্রার পথে মাত্র নব্বই মাইল দূরে! জাটদের হঠাৎ কি হল? আওরঙ্গজেব জানেন জাহানারা এখন বলবেন, হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে তিনি যে কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন তার ফলশ্রুতিতে তাঁর শাসনের বিরুদ্ধে জাটদের ধূমায়িত অসন্তোষ এখন প্রকাশ্য প্রজাবিদ্রোহে রূপ নিয়েছে। ঠিক আছে তাই যদি হয় হোক সেটা। এতে আরো ভালো হবে। এর অর্থ তার শত্রুরা এখন জ্বলন্ত গোলা থেকে ইঁদুরের মতো ঘর ছেড়ে বাইরে চলে এসেছে। আর তিনি তাদেরকে ধ্বংস করবেন, যার জন্য ওরা উপযুক্ত!
*
এক একটা মিনিট যাচ্ছে আর দিগন্তের উপর লাল ধূলির মেঘটি সগর্জনে আরো বড় হচ্ছে। বিশালদেহী রণ-হস্তির পিঠে হাওদায় সোজা হয়ে বসে আওরঙ্গজেব হাত দিয়ে রোদ আড়াল করে সামনে দূরে বৃক্ষশূন্য বালুকাময় সমতলভূমির উপর দিয়ে ছুটে আসা ঘোড়সওয়াড় দলটির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। একটু পরই তিনি এক এক করে আলাদা লোকগুলোর অবয়ব আর সবার আগের ঘোড়সওয়াড়ির বর্শার চকচকে ডগাটি দেখতে পেলেন। তিনি জানতেন জাটরা অনভিজ্ঞ উচ্ছঙ্খল জনতা আর মনে হচ্ছে সেভাবেই ওরা হঠকারীর মতো তাঁর নিজের সুশৃঙ্খল বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে। আসুক ওরা।
বিদ্রোহের কথা কানে আসতেই তিনি তার সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত হবার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং দ্রুত হঠাৎ গজিয়ে উঠা বিরোধী পক্ষের দ্বিগুণ সংখ্যক সেনা নিয়ে গঠিত দুটি দল সামনে পাঠালেন। একটি সেনাদল গেল আগ্রা থেকে আর অপরটি দিল্লি থেকে। তিনি নিজে পরবর্তী সেনাদলের সাথে চললেন। তবে তিনি যেরকম আশা করেছিলেন সেরকম দ্রুত বেগে ওরা চলতে পারলো না। ভারি ভারি কামান নেওয়ার কারণে তাদের চলার গতি একটু সুথ হয়ে পড়েছিল। তবে কামান নেওয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল, কেননা জাটদের কোনো কামান নেই আর এতে ওদের বিরুদ্ধে একটু বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে। সময় বাঁচাবার জন্য তিনি রাতেও চলার নির্দেশ দিলেন, তবে কামান টেনে নিয়ে চলা বড় বড় সাদা ষাঁড়গুলো চলার গতি থামিয়ে ধপ করে বসে পড়লো। লম্বা চাবুক দিয়ে গাড়োয়ানরা বার বার আঘাত কষালেও, সারাদিন দীর্ঘপথ চলায় ক্লান্ত পশুগুলো আর উঠে দাঁড়াল না। গোলন্দাজ বাহিনী, পদাতিক বাহিনী, রসদবহর টানা গাড়ি আর শিবিরের অন্যান্য লোকজন সবাই একসাথে মিশে জট পাকাতে শুরু করলো। প্রায় বিশৃঙ্খল হয়ে পিছিয়ে পড়া সেনাদলটি ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ করে যাওয়ার সময় তার কাছে খবর এল যে, শত্রুর গতিবিধি লক্ষ করার জন্য মূল দলের আগে একেবারে সামনের প্রান্তে ছোট অগ্রবর্তী দলটির উপর দুটি বাঘ উপরি আক্রমণ করে দুজনকে মেরে ফেলেছে। এই খবরটির উপর তিনি খুব একটা আস্থা রাখতে পারলেন না, কেননা বাঘ সাধারণত একাই শিকারের উপর আক্রমণ করে। এধরনের গুজব বরং আরো বিভ্রান্তি সৃষ্টি করলো। দলটি পুরোপুরি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ার আগেই তিনি রাতে চলা বাদ দিলেন।