মঞ্চের পেছনে পর্দা ঘেরা জায়গা থেকে জাহানারাসহ রাজপ্রাসাদের মহিলারা অনুষ্ঠান দেখবেন। তাঁর কথাতেই এই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে, এটা রাজবংশের অতীতের ঘা নিরাময় করা ছাড়াও সাম্প্রতিক বিরোধের মীমাংসার পথ মসৃণ করবে। হিন্দুদের সাথে তার আচরণ নিয়ে জাহানারার সাথে মতভেদ হওয়ার পর থেকেই তিনি অনুভব করছিলেন যে, দুজনের মধ্যে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে–এমনকি তিনি ভেবেছিলেন হয়তো জাহানারা তাঁর সাথে দিল্লি ফিরে যাবেন না। আগ্রা দুর্গে বন্দী জীবন কাটাবার বছরগুলোতে জানি তার সাথেই ছিলেন। আর যেভাবে তিনি জানির সম্পর্কে কথা বলেছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল জানিকে তিনি নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন। এই বিয়েতে সম্মতি দিয়ে আর দিল্লিতেই বিয়ের অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করে আওরঙ্গজেব চাচ্ছিলেন যে, জাহানারা রাজদরবারে ফিরে আসুন।
আজম কনের পাশে তার নির্দিষ্ট আসনে বসতেই আওরঙ্গজেব মোল্লাকে বিয়ে পড়াতে ইশারা করলেন।
মোল্লা প্রথম জানিকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এই মানুষকে আপনার স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি?”
কয়েকপ্রস্থ ঘোমটার আড়াল থেকে তার পরিষ্কার জবাব শোনা গেল, হ্যাঁ।’
এরপর মোল্লার কথায় আজমও বিয়েতে তার মত দিলেন এবং যথারীতি বিয়ের দোয়া পড়তে শুরু করলেন। তারপর আওরঙ্গজেব চকচকে বিয়ের টায়রা মুকুটটি তাক থেকে তুলে তার ছেলের মাথায় পরিয়ে দিলেন। মুকুটের সোনার তারে বসানো মুক্তাগুলো হাওয়ায় ফুলের মতো কাঁপছিল। সবশেষে তিনি খানসামার হাত থেকে এক বাটি গোলাপজল নিয়ে তাতে আলতোভাবে দুই হাত ধুলেন, এরপর আরেকজন পরিচারক এক গ্লাস পানি দিতেই তিনি বিয়ের আনুষ্ঠানিক প্রথানুযায়ী তা সম্পূর্ণ পান করে বরকনের পবিত্র মিলন নিশ্চিত করলেন।
নববধূ আর বর দীর্ঘজীবী হোক। তাদের মিলনে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। আর তারা অনেক সন্তানের জন্ম দিক!
রাজকীয় ভোজে অংশ গ্রহণের জন্য যাদেরকে অবশ্যই আমন্ত্রণ করার কথা তাদের সবার জন্য জাহানারার ছোট্ট মহলে স্থান সংকুলান হওয়ার কথা নয়। সেজন্য আওরঙ্গজেব দিওয়ান-এ-আমের সামনে দুগের বিশাল খিলানে ঢাকা উঠানে বিশালাকায় চারকোণা তাঁবু টাঙাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। ফুলবাগান আর গোলাপজলের বুদ্বুদ উঠা ফোয়ারা পার হতেই তিনি জাফরান, ঘি আর মাখন দিয়ে রান্নাকরা খাবারের খুশবু অনুভব করলেন। সম্রাটের বাবুর্চিরা গত কয়েকসপ্তাহ থেকেই রান্নার প্রস্তুতির জন্য সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে সর্বোৎকৃষ্ট সামগ্রী আনার জন্য বায়না দিয়ে চলেছিল। হিরাটের চারপাশের বিভিন্ন বাগান থেকে মিষ্টি রসালো তরমুজ, সুমিষ্ট আঙ্গুর আর ডালিম, পাঞ্জাব থেকে কাঠবাদাম আর আখরোট, কাশ্মির থেকে শুকনো খুবানি আর চেরি, রাজকীয় শিকারের জঙ্গল থেকে তিতির পাখি, কোয়েল জ্যান্ত ধরে দিল্লি নিয়ে আসা হবে, উত্তরের পাহাড়ি এলাকা থেকে খাদ্যের স্বাদগন্ধ বাড়াতে পুদিনা, মৌরি এবং ধনেপাতা, এবং দক্ষিণ থেকে গরম মশলা…
গুম গুম করে বেজে ওঠা নাকাড়া আর শিঙাধ্বনির সাথে সাথে সামনে পেছনে দেহরক্ষীদল নিয়ে আওরঙ্গজেব তাঁবুতে ঢুকলেন। তাঁবুর ঠিক মাঝখানে মখমলে ঢাকা একটি মঞ্চের উপর একটি নিচু টেবিল পাতা হয়েছিল, তিনি এই টেবিলের পেছনে তার আসনে বসলেন। আবার নাকাড়া বাজিয়ে আজম আর অন্য শাহজাদাদের আগমন ঘোষণা করা হল। বর আওরঙ্গজেবের পাশে বসলেন আর মুয়াজ্জম আর আকবর একটু নিচে একটি ডিভানে বসলেন। তিনজনকেই খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। পেশিবহুল মুয়াজ্জম তার কাশ্মিরি রাজপুত মায়ের কাছ থেকে চওড়া কপাল, লম্বা টিকেলো নাক এবং শক্ত চোয়াল পেয়েছেন। মাত্র কিছুদিন আগে শাহজাহান জোর করে তাকে যে নওয়াব বাঈয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন, তার চেয়েও মুয়াজ্জমের কপাল আর নাক অনেক সুন্দর। আজম আর বালক আকবরের সাথে তাদের পারসিক মা দিলরাস বানুর চেহারার খুব একটা মিল নেই। তিনি আওরঙ্গজেবের প্রধান মহিষী ছিলেন, পুত্র আকবরকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। তবে এদের দুজনের মধ্যেই বিশেষত–আজমের মাঝে তিনি নিজের ছায়া খুঁজে পান। একটি মুহূর্ত তার মনে সবচেয়ে বড়ছেলে মোহাম্মদ সুলতানের চেহারাটা ভেসে উঠলো। তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করলে ইঁদুরের সাথে অন্ধকার কারাকক্ষে পঁচে মরার বদলে, আজ সেও এই উৎসবে সামিল হত। তবে মোহাম্মদ সুলতানের পরিণতি আল্লাহর সামনেই রয়েছে আর পৃথিবীর সামনেও রয়েছে। এজন্য তার মনে কোনো আফসোস নেই…
সোনালি এমব্রয়ডারি করা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে আওরঙ্গজেব ভোজ শুরু করার ইঙ্গিত দিলেন। সবুজ পোশাকপরা খানসামারা সর্বপ্রথম বড় বড় সোনার বারকোশে রোস্ট করা ময়ূর নিয়ে এল। ময়ূরের লম্বা উজ্জ্বল পালক ছড়িয়ে রয়েছে। আরো আনলো খাসি আর হরিণের মাংসের রোস্ট। এরপর এল পোলাও, যার উপরে ছড়ান রয়েছে সোনার পাতা মোড়ানো ফল আর বাদাম। আরো এল জাফরান দেওয়া ভাত, কাঠবাদাম আর কিসমিস দেওয়া সুগন্ধিযুক্ত সদ্য সেঁকা রুটি আর ঢাকনা দেওয়া সোনালি আর রুপালি রঙের স্যুপভাণ্ডে আখনি দেওয়া মৃদু ফুটন্ত অবস্থায় বাবুর্চির মন-পসন্দ বিশেষ ধরনের রান্না। আওরঙ্গজেব খেতে পছন্দ করেন, তবে তিনি অন্যদের আগেই খাওয়া শেষ। করেন, যাতে কেউ তাকে পেটুক মনে না করতে পারে। তারপর যখন স্ফটিকের পাত্রে বিভিন্ন ফল আর সোনালিপাতে মোড়ানো মিষ্টি টেবিলে টেবিলে পরিবেশন শুরু হল, তখন তিনি উঠে পড়লেন এবং সবুজ রেশমি ঝালর দেওয়া কাঠের পার্টিশনের ওপারে মেয়েমহলের দিকে গেলেন।