তাহলে এটা সত্যি–শিবাজি বাঘ-নখ ব্যবহার করেছিলেন?
হ্যাঁ, ওটা তিনি তার ডান হাতে লুকিয়ে রেখেছিলেন। আর তার ধারালো ইস্পাত দিয়ে কাজটি সমাধা করেন। যখন শিবাজি আফজাল খানের দেহরক্ষী সাঈদ বান্দার দিকে ফিরলেন, তখন পালকির সেই সাহসী বেহারাগুলো ছুটে এসে সেনাপতিকে ধরাধরি করে পালকিতে তুলে নিল। তারপর পেছনে রক্তের ধারা ফেলে রেখে পালকি নিয়ে পথে নামলো। আমি চিৎকার করে আমার লোকদেরকে বেহারাদের পাকড়াও করতে বললাম, এদিকে আফজাল খানকে। পালকি থেকে টেনে নামালাম। তখন তার মুমূর্ষ অবস্থা, কাজেই খুব সহজেই তার বিশাল ভূঁড়িতে তরোয়াল ঢুকিয়ে তাকে শেষ করে দিলাম। তারপর শিবাজির দিকে ছুটে গেলাম, ভেবেছিলাম সাঈদ বান্দাকে হত্যা করে অপমানের প্রতিশোধ নেবো, এতে শিবাজিকেও সাহায্য করা হবে। কিন্তু তরোয়ালধারী লোকটি ততক্ষণে মর মর অবস্থায় হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছিল। বাঘ-নখের আঘাতে তার গলা চিরে দুফাঁক হয়ে গিয়েছিল, সে দু-হাতে গলা ধরে রেখেছিল। তার কণ্ঠনালী চিরে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরে দাক্ষিণাত্যের লাল মাটি ভিজে যাচ্ছিল। প্রায় শাসরুদ্ধ হয়ে সেনানায়ক কথা থামালো, সে যেন আবার সেই লড়াইয়ে ফিরে গেছে।
কয়েক মুহূর্ত পর তার সঙ্গী বললো, এই গল্প বার বার শুনেও আমার ক্লান্তি নেই। কিন্তু আপনার কি মনে হয়, শিবাজি আমাদেরকে আজ কেন এখানে ডেকেছেন? নতুন কোনো অভিযানের পরিকল্পনা হচ্ছে নাকি?
সেটা শীঘ্রই জানতে পারবো।
লোক দুটি শিবাজির প্রধান তাঁবুর কাছে পৌঁছে ঘোড়া থেকে নামতেই গোধূলি হয়ে এলো। তাঁবুর ভেতরে ঢুকে ওরা দেখলো মারাঠি নেতা ইতোমধ্যেই জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে চলেছেন। মারাঠিদের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি যার কোনো শ্রদ্ধা নেই, সেই মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে মারাঠিদের দেশে একজন ভিনদেশি হানাদার হিসেবে ধিক্কার জানাতে গিয়ে প্রচণ্ড আবেগে তার দু-চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছিল। তিনি আমাদেরকে বলেন, পাহাড়ি ইঁদুর, অথচ তিনি নিজেই একজন পরজীবী কীট। ক্ষমতার লোভে নিজের ভাইদেরকে শেষ করে দিয়েছেন। অন্যায়ভাবে সিংহাসন দখলের জন্য এতোগুলো বছর তাঁর পিতাকে বন্দী করে রেখেছেন, যা তাঁর নিজ ধর্ম বিশ্বাসে একটি গর্হিত অপরাধ। ইঁদুর হই বা না হই, আমরা তাঁর হাত কামড়ে দিয়েছি আর বার বার কামড়াতেই থাকবো যতক্ষণ না আমরা তাঁর কবল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হই।
জ্বালাময়ী ভাষণ এবং নাটকীয় অঙ্গভঙ্গি দিয়ে শিবাজি তার লোকদের মনে উত্তেজনার আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে তার পরিকল্পনা খুলে বললেন। আমরা উত্তর পশ্চিমে যাবো, ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে রাতে চলবো, যাতে লোকজনের চোখে না পড়ি। তারপর সবাই একত্রিত হয়ে মোগলদের সম্পদশালী সুরাট বন্দর আক্রমণ করে লুণ্ঠন চালাবো। আমার গুপ্তচরেরা জানিয়েছে গর্বিত আওরঙ্গজেব বোকার মতো এই বন্দরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল রেখেছেন। তাঁর বিশ্বাস কেউ এখানে আক্রমণ করতে সাহস করবে না। শীঘ্রই জানতে পারবেন, তার নিজের আর আমাদের লোকদের সামনে তাকে নতজানু হতে হবে। এখন সবাই যাও, যুদ্ধের জন্য আর সেই সাথে অর্জিত পুরস্কার ও চিরস্থায়ী বিজয় গৌরবের জন্য প্রস্তুত হও! তার কথায় সায় দিয়ে তার সেনানায়কেরা গর্জে উঠলো।
দেরিতে আসা দুই সেনানি বের হওয়ার সময়, একজন অপরজনকে বলছিল, এবার আওরঙ্গজেবের গলাকে বাঘ-নখ থেকে সতর্ক হতে হবে।
*
ঘোড়ায় চড়ে শিবাজি বললেন, এখনই সময়। মোগলদেরকে তাদের অপরাধ আর বিজয় অভিযানের জন্য রক্ত দিয়ে মূল্য দিতে হবে। তাদেরকে মনে করিয়ে দিতে হবে হিন্দুস্তান আমাদের, তাদের নয়। তারপর তিনি পায়ের গোড়ালি দিয়ে কালো ঘোড়াটির পাঁজরে গুঁতো দিলেন। একটি ঝোঁপের আড়াল থেকে লাফ দিয়ে বের হয়ে ঘোড়াটি সৈকতের নরম বালুর উপর দিয়ে ছুটে চললো। পাঁচশো লোক নিয়ে শিবাজি সুরাটের চারপাশ ঘিরে থাকা নিচু মাটির দেয়ালের দিকে ছুটে চললেন। পশ্চিম দিকে তার মাসব্যাপী যাত্রা বেশ দ্রুত হয়েছিল এবং অধিকাংশ সময় তারা কারও চোখে পড়েনি। তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে চলছিল। যেসব মোগল সেনানায়ক এসব ছোট ছোট দলের কথা শুনেছিল তারা এদেরকে ঘুরে বেড়ানো ডাকাত মনে করে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে নিজেদের আরাম আয়েশে মত্ত হয়ে পড়ে। অবশ্য শীঘ্রই তারা এবং তাদের মতো অন্যরাও নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে।
ঘামে ভেজা দেহ নিয়ে ঘোড়াটি প্রতিরক্ষার প্রথম বাধা-তিনফুট উঁচু দেয়ালটি টপকাতে এক লাফ দিতেই শিবাজি তার তরোয়াল সামনে বাগিয়ে ঘোড়াটির ঘাড়ের দিকে একটু ঝুঁকলেন। দেয়ালের পেছন থেকে আত্মরক্ষার জন্য দাড়িওয়ালা একজন মোগল সৈন্য এক হাত উঠাতেই শিবাজি তার তরোয়ালের এক কোপে সৈন্যটির হাত কব্জি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন। সৈন্যটিকে পেছনে ফেলে শিবাজি আবার তরোয়াল চালালেন। দ্বিতীয় আঘাতটি পড়লো একজন মোগল সেনা কর্মকর্তার মুখে। লোকটির দাঁত ভেঙ্গে রক্তাক্ত চোয়াল বুকের উপর ঝুলে পড়লো। সামান্য যে কজন মোগল সেনা বাইরের দেয়াল প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিল, তারা শহরের ভেতরের দেয়ালের দিকে ছুটে চললো। কয়েকজন তাদের অস্ত্র ফেলে ছুটে পালালো। তারপর শিবাজি একের পর এক গাদা বন্দুকের গুলি ছোঁড়ার ফট ফট আওয়াজ শুনতে পেলেন। তার পাশের বেগুনি রঙের পাগড়িপরা মারাঠি সৈন্যটি বুকে হাত চেপে ধীরে ধীরে ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। পেছন থেকে ছুটে আসা ঘোড়াগুলো খুর দিয়ে তাকে মাড়িয়ে গেল। কাছাকাছি আরেকটি ঘোড়া পা ভাঁজ করে বালুর উপর লুটিয়ে পড়লো, সাথে সাথে এর আরোহীও ছিটকে মাটিতে পড়লো। তারপর আরো দুই-তিনজন মারাঠি মাটিতে পড়ে গেল। তবে বাদবাকিরা দৃঢ়তার সাথে ঘোড়া ছুটিয়ে চললো।