এক মুহূর্ত পর রওশনআরা বললেন, হ্যাঁ। তার মুখে খুশির মৃদু হাসি দেখে আওরঙ্গজেব বুঝলেন যে, তাঁর পরিকল্পনায় কাজ হয়েছে। তিনি সব সময় জানতেন কিভাবে তার বোনকে সামলানো যায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি একা থাকতে পছন্দ করতেন না, সব সময় চাইতেন কেউ না কেউ তাকে সঙ্গ দিক, সবাই তাকে দেখুক আর তাকে গুরুত্ব দিক। আর এতে তার মধ্যে এমন একটি ভাব হত যে, তোষামোদে সহজেই ভুলে যেতেন আর কেউ অবজ্ঞা করলে ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা হত। জাহানারা রাজদরবারে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত তিনি নিজের শক্তিতে আস্থাহীন ছিলেন–এমনকি আওরঙ্গজেবের প্রতিও শ্রদ্ধাবান ছিলেন। সব সময় তাঁকে খুশি করতে চেষ্টা করতেন। পরবর্তীতে বড় বোনের প্রতি তাঁর বিরক্তি আর ঈর্ষা তার উপর চেপে বসে। এখন থেকে তার সাথে ঘন ঘন দেখা করতে হবে, তার প্রশংসা করতে হবে বিশেষত সবার সামনে আর প্রচুর উপহার দিতে হবে। আওরঙ্গজেব তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, এখন আমাকে ক্ষমা কর। মাগরেবের নামাজের আগে আমাকে প্রচুর কাজ করতে হবে।
আবার একা হওয়ার পর আওরঙ্গজেব জানালার ধারে একটা কৌচে বসে চোখ। বুজে দুই হাত চিবুকের নিচে রেখে চিন্তায় মগ্ন হলেন। বিয়েটা দশ সপ্তাহের মধ্যে হবে আর তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন এটাকে জমকালো করতে। সম্প্রতি তিনি যে প্রতিজ্ঞা করেছেন, সাধারণ পোশাক পরবেন আর রত্নালঙ্কার পদদলিত করবেন, সেই কারণে এই উৎসবটিকে সর্বশ্রেষ্ঠ করা থেকে থামানো যাবে না। এমন উৎসব করতে হবে যা তাঁর প্রজারা কখনও দেখেনি। বিয়ের উৎসবটি জমকালো করার এক মাত্র উদ্দেশ্য হল, সারা পৃথিবীকে মোগল সাম্রাজ্যের সম্পদ আর স্থায়িত্ব দেখান আর সর্বোপরি এই সাম্রাজ্যকে যে তিনি দৃঢ়মুষ্টিতে ধরে রেখেছেন তাও সকলকে দেখান।
*
দিল্লির লাল কেল্লায় জাহানারার চমৎকার মহলের সিঁড়ির সবচেয়ে উঁচু ধাপে দাঁড়িয়ে আওরঙ্গজেব শোভাযাত্রা সহকারে বরের আগমন দেখছিলেন। মোগল কায়দার সবুজ পোশাকপরা পাশাপাশি দশজন করে মোট দুইশোজন বেহারা খাঁটি সোনার থালায় মণিমুক্তা, স্বর্ণমুদ্রা আর দামি মশলা গোলমরিচ, দারুচিনি আর লবঙ্গ নিয়ে সমান তালে পা ফেলে হেঁটে সবার সামনে এগিয়ে আসছে। ওদেরকে অনুসরণ করছে রূপালি শিরস্ত্রাণ আর বুকে বর্মপরা রাজকীয় অশ্বারোহী বাহিনীর একটি দল। ওদের কালো ঘোড়ার কেশর রেশমের মতো ঝিকমিক করছে।
এর পেছনেই সোনালি জ্যাকেটপরা চৌদ্দ বছর বয়সি আজম লম্বা গলা, বড় বড় চোখ আর ফাঁকাসে পশমের একটি আখালটেক ঘোড়ায় চড়ে আসছিল। আওরঙ্গজেব এই ঘোড়াটি তাকে বিয়ের উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। আমু দরিয়ার ওপারে জন্ম নেওয়া আখালটেক ঘোড়াগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগামী এবং টেকসই ঘোড়া। এই ঘোড়ায় চড়েই তাদের পূর্বপুরুষ চেঙ্গিস খান তার বিজয় অভিযান চালিয়েছিলেন। আজমের একপাশে চব্বিশ বছর বয়সি মুয়াজ্জম, যে ইতিমধ্যেই বিবাহিত আর অন্যপাশে নয় বছর বয়সি আকবর। দুজনেই রুপালি রঙের পাগড়ি আর জ্যাকেট পরে রয়েছে। ওদের পোশাক আর পাগড়িতে বসানো হীরাগুলো রোদে আগুনের মতো ঝিকমিক করে জ্বলছিল। আওরঙ্গজেব সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। পার্থিব জিনিসের বিষয়ে গর্ব করাটা ঠিক না হলেও, ময়ূর সিংহাসনে বসার পর আর কখনও এমন অনুভূতি তার হয়নি যা আজ এই প্রথম হল…
প্রথম সারির কুলিরা মহল থেকে চল্লিশ ফুট দূরে থাকতেই ওদেরকে সেখানেই থামার জন্য মহলের ছাদ থেকে সূর্যধ্বনির সংকেত শোনা গেল। কুলিরা সাথে সাথে থেমে পড়ে থালাসুদ্ধ হাত সামনে বাড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর দুই সারিতে বিভক্ত হয়ে পাঁচজন ডানে আর পাঁচজন বামে তিন পা এগিয়ে গেল। ওদের পেছনে দেহরক্ষীবাহিনীও ঘোড়ার রাশ টেনে দুই দিকে ভাগ হয়ে ঘোড়া দাঁড় করালো। দুই ভাইকে পেছন পেছন দুই পাশে নিয়ে মাঝখানের পথ দিয়ে আজম ওর ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে এল। মহলের সিঁড়ির গোড়ায় এসে তিনজনই ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়াল আর আজম সিঁড়ি বেয়ে উঠে আওরঙ্গজেবের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বললো, আপনার দোয়া দিন বাবা।
‘আমার দোয়া তোমার উপর রয়েছে। এখন উঠে আমার সাথে ভেতরে এস। তোমার কনে সেখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
এখন যদিও দিনের আলো রয়েছে, তাসত্ত্বেও জাহানারার মহলে সোনার বাতিদানে লম্বা সুগন্ধিযুক্ত মোমবাতি জ্বলছে। এর সুগন্ধের সাথে ধূপ আর চাপা ও উঁই ফুলের মালার সৌরভ মিশে লাল বেলেপাথরের স্তম্ভগুলোর চারপাশে পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে। মূল অনুষ্ঠানটি হবে মহলের প্রস্থ বরাবর এপাশ থেকে ওপাশে চলে যাওয়া উঁচু ছাদ আর মার্বেল পাথরের মেঝের বিরাট একটি কামরায়। অতিথিরা সেখানেই সমবেত হয়েছেন। আওরঙ্গজেব ঢুকেই দুইপাশে নজর বুলিয়ে দেখলেন সমস্ত আয়োজন ঠিক আছে কি-না। অসংখ্য তারা এমব্রয়ডারি করা সোনালি রঙের রেশমি কাপড়ের ঘোমটার আড়ালে ফুল আঁকা একটি মঞ্চে জানি বসে রয়েছে। মঞ্চের পাশেই একটি মার্বেল পাথরের তাকের উপর বিয়ের মুকুট রাখা ছিল, যেটা আওরঙ্গজেব আজমের মাথায় পরাবেন। এই মঞ্চটি কাশ্মির থেকে প্রজারা উপহার পাঠিয়েছে। জানির কোলের উপর আংটি পরা দুটি হাত ভাঁজকরা রয়েছে আর মেহেদি লাগানো দুই পা দেখা যাচ্ছিল।