আরঙ্গজেবের ঠোঁট থেকে হাসি মুছে গেল, তিনি বললেন, এটা আমার একার সিদ্ধান্ত ছিল। এমনকি মোল্লাদের সাথে আলোচনা করলেও সিদ্ধান্ত একা আমিই নেব। আল্লাহর নামে বলছি জাহানারা, আমি জানি যে আমি ঠিকই করছি।’
তুমি যখন ছোট ছেলেটি ছিলে, তখন তুমি খুব একরোখা ছিলে। যা সঠিক মনে করতে তার জন্য তোমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় বড় ছেলেদের সাথে লড়াই করতে। আমি তোমার সাহস দেখে তোমাকে আরো ভালোবাসতাম আবার সেই সাথে তোমার জন্য দুশ্চিন্তাও করতাম। যখন কোনো ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলো তখন তুমি খুব সরল মনে দুনিয়াকে বিচার কর–ভালো আর মন্দ তোমার কাছে সাদা আর কালোর মতো। তুমি সব সময় আশা কর। পৃথিবী যৌক্তিক পথে নয় বরং তোমার যুক্তিমতো চলুক। যদি হিন্দু প্রজারা তোমার ক্ষমতা প্রদর্শনের সামনে মাথা নত না করে, তাহলে কি হবে? তুমি কেবল তোমার আর তোমার উত্তরাধিকারীদের জন্য তকলিফ আর অসন্তুষ্টি সৃষ্টি করবে যার কোনো প্রয়োজন নেই।
মিনতি নিয়ে আওরঙ্গজেবের মুখের দিকে তাকাতেই তাঁর চোখে পানি চলে এল। তবে আওরঙ্গজেবের চেহারায় কোনো ধরনের আবেগ কিংবা প্রতিক্রিয়া নেই দেখে তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারলেন, এতক্ষণ যে কথাগুলো বলেছেন তা পরোপুরি বিফলে গেছে। পেছনে ফিরে তিনি দ্রুত কামরা থেকে বের হয়ে গেলেন। আওরঙ্গজেব তাকে অনুসরণ করতে উদ্যত হলেন–তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর মনে ব্যথা দিয়েছেন, যা তিনি কখনও চান নি। তবে নিজেকে থামালেন। আর কিই বা তিনি বলতে বা করতে পারেন? জাহানারার জানা উচিত ছিল যে, জাগতিক বিষয়ে তার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসা করে কোনো লাভ নেই। এটা তাকে শিখতে হবে।
০৪. বিদ্রোহ ধূলিসাৎ হল
রওশনআরা মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, মনে রেখো জানি হচ্ছে–দারার মেয়ে! যে বিশ্বাসঘাতককে তুমি ঘৃণা কর তার মেয়েকে কেন ছেলের বউ বানাচ্ছ? অনেক সময় আমি তোমাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।’
আওরঙ্গজেব ভাবলেন, তবে আমি তোমাকে ঠিক বুঝি। যেহেতু জাহানারা এই প্রস্তাবটি এনেছে শুধু একারণেই আজম আর জানির মধ্যে এই বিয়েতে তিনি রাজি হচ্ছেন না। বড় বোনকে সাম্রাজ্যের পাদিশাহ বেগমের পদে পুনর্বহাল করায় রওশনআরা তার ক্ষোভ চেপে রাখতে পারে নি। একটা বাচ্চামেয়ের মতো অস্থিরভাবে ঠোঁট ফুলিয়ে তিনি বললেন, এটা ঠিক না। সে নয়, আমিই তোমার প্রতি বিশ্বস্ত ছিলাম! আগ্রা দুর্গ থেকে পালিয়ে এসে কে তোমার শিবিরে যোগ দিয়েছিল? সেটা জাহানারা নয়–সেটা ছিলাম আমি! কে তোমাকে জানিয়েছিল আগ্রা দুর্গের প্রতিরক্ষার জন্য আমাদের বাবা কতজন প্রহরী আর কয়টা কামান রেখেছেন? আমি!’ প্রথম প্রথম আওরঙ্গজেব মিষ্টি কথায় তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছিলেন, তারপর চমৎকার গোলকুন্ডা হীরা বসানো সুন্দর একটা সোনার হার দিয়েছিলেন। রওশনআরা সাগ্রহে সেটা গ্রহণ করেছিলেন–আর করবেন না কেন? তিনি রত্ন খুব ভালোবাসেন। তা সত্ত্বেও রাজদরবার দিল্লিতে ফিরে আসার পর তিনি মুখ গোমড়া করে হেরেমে নিজের ঘরেই বসেছিলেন আর একবারও জাহানারাকে দেখতে তার প্রাসাদে যান নি। আর এখন…
আওরঙ্গজেব বললেন, ‘বোন, আমাকে বিচার করতে দিন কোনটি আমাদের পরিবারের জন্য সবচেয়ে ভালো হবে। এমনকি আগ্রা থাকাকালীন আমি লক্ষ করেছি আজম তার চাচাতো বোনের প্রতি একটু বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছিল– আর আপনি নিজেও এ সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, তাই না?
হ্যাঁ–সতর্ক হওয়ার জন্য বলেছিলাম! তবে আমি কখনও একথা ভাবি নি যে তুমি তাদের বিয়ে দিতে চাইবে।
আওরঙ্গজেব বললেন, ‘দারার মেয়ের সাথে আমার একজন ছেলের সম্পর্ক করলে আমার অবস্থান আরো শক্তিশালী হবে, কমবে না। আর এতে দুনিয়ার সবাই জানবে যে, অতীতে আমাদের সম্পর্কে যে ফাটল ধরেছিল তা আমি মেটাতে চাই।’ কথাগুলো বলার সময় আওরঙ্গজেব সচেতন হলেন যে, প্রায় একই কথা জাহানারা তাকে বলেছিলেন।
কিন্তু তুমি আমাকে সব সময় বলতে যে, আজমের সাথে কোনো অভিজাত ব্যক্তির মেয়ে কিংবা বিদেশি কোনো শাহজাদির বিয়ে দেবে…?
‘তা এখনও করা যায়…শুধু জানিই আজমের একমাত্র স্ত্রী হবে কেন?
যাই হোক তোমার উচিত ছিল অন্তত এই বিয়ের ব্যাপারটা আমাকেই প্রথমে বলা, অথচ আমাকে হেরেমের অন্যের কাছ থেকে খবরটা শুনতে হল। ভেবে দেখেছ এতে আমার মনের অবস্থা কি হয়েছে? অন্য আরেকজন মহিলার দিকে তাকিয়ে আমার কিরকম লেগেছিল বলো তো?”
‘আমি দুঃখিত, সত্যি আমার ভুল হয়ে গেছে। তোমাকেই আমার প্রথমে বলা উচিত ছিল।’
‘এখন যে সেটা বুঝতে পেরেছ সেজন্য আমি খুশি হয়েছি।’
‘সেক্ষেত্রে আমিও আশা করি যে, তুমি বুঝবে কেন আমি বিয়েটা দিতে চাচ্ছি। যাই হোক, তোমাকে দেখে আমি খুশি হয়েছি, কারণ একটা ব্যাপারে আমার তোমার সাহায্য প্রয়োজন।’
‘আমার সাহায্য?
‘চাকরি করার সময় আমাদের যেসব কর্মকর্তা মৃত্যুবরণ করে, তাদের বিধবা স্ত্রী আর পরিবারের সাহায্য করার জন্য আমি একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলাম। খাজাঞ্চী আমাকে জানিয়েছে এখানে প্রচুর দেনা হয়েছে, অথচ আমি প্রতিবছর এতে হাজার হাজার রুপি অনুদান দেই। সম্ভবত এটা ঠিক মতো চালাতে পারছে না কিংবা কেউ তহবিল তছরূপ করছে। তোমাকে ছাড়া আর কাউকে আমি উপযুক্ত ভাবতে পারছি না, যে বিষয়টা তদন্ত করে আমাকে জানাবে। তুমি কী কাজটা করবে?