‘অবশ্যই। তাকে এখানে নিয়ে এস। জাহানারা কামরায় ঢুকতেই আওরঙ্গজেব তাঁকে স্বাগত জানিয়ে বললেন, ‘আসুন বোন। তিনি তখনও তাঁর বাবার জন্য শোকের সাদা পোশাক পরেছিলেন, যদি নিয়মমাফিক সে সময় পার হয়ে গেছে।
তিনি আওরঙ্গজেবের হাত একমুহূর্ত ধরে রেখে তারপর বললেন, ‘ধন্যবাদ আওরঙ্গজেব, আমার সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছ, সেজন্য ধন্যবাদ।
আওরঙ্গজেব তাঁর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, আপনার চেহারা আগের চেয়ে ভালো দেখাচ্ছে। আসলেই এটা সত্যি। গত কয়েকমাসে তার চেহারা অন্যরকম ছিল। তবে একটু কাছে এগিয়ে তিনি দেখলেন আজ রাতে তার অভিব্যক্তিতে বেশ টান টান আর উদ্বিগ্ন ভাব দেখা যাচ্ছে। আওরঙ্গজেব বললেন, ‘কি ব্যাপার আপনি এত রাতে এখানে জাহানারা?
‘তোমার সাথে আমার অতি জরুরি কিছু কথা বলার প্রয়োজন ছিল। একটু আগে যা শুনতে পেলাম, তা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। তুমি নাকি হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব পালন নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছ আর ওদের কয়েকটা মন্দির ভেঙ্গে ফেলতে চাচ্ছ। আমার একজন পরিচারিকা বললো তার স্বামী নাকি আজ সন্ধ্যার নামাজে মতি মসজিদে মোল্লাকে এই ঘোষণা দিতে শুনেছে। এটা কি আসলে সত্যি?
হ্যাঁ, কথাটা সত্যি। বেশ কিছুদিন ধরে আমি এই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছিলাম। তবে শিবাজির অবাধ্যতা প্রমাণ করেছে যে, অন্যরা তার দেখাদেখি বিদ্রোহ শুরু করার আগেই আমার কর্তৃত্ব হিন্দুদের সামনে দেখাবার এটিই সঠিক সময়। প্রজাদেরকে দেখাতে হবে যে, আমার সহ্যের একটা সীমা আছে আর তাছাড়া ভেতর-বাইরের যে কোনো ধরনের হুমকি থেকে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা আমার কর্তব্য।
‘কিন্তু হিন্দুরা তো তোমার প্রজাদের মধ্যে অনেক সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর অনেকেই সাম্রাজ্যের ভাল এবং বিশ্বাসী সেবক। আমাদের পূর্বপুরুষদের আমল থেকেই ওরা আমাদের প্রতি বিশ্বস্ত। বিদ্রোহের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। ভেবে দ্যাখো আমাদের নিজ ধর্ম থেকেই তো অনেক শত্রু এসেছে সেই বিজাপুর আর গোলকুন্ডার সুলতান থেকে শুরু করে পারস্যের শাহ, আর আমাদের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের উচ্ছঙ্খল আফগান গোত্র পর্যন্ত কতজন আছে বল। এদের তুলনায় আমাদের বিশ্বস্ত হিন্দু প্রজারা এমন কি করেছে যে, তাদের ক্ষেত্রে এটা হবে? ওদের ধর্মের বিরুদ্ধে যাওয়া মানেই ওদেরকে সরাসরি শিবাজির মতো রাজদ্রোহীর শিবিরে ঠেলে দেওয়া। তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না, যে আশংকা তুমি এড়াতে চাইছো এতে বরং তা আরো সৃষ্টি হবে? আওরঙ্গজেবের ঠোঁট থেকে হাসি মুছে গিয়ে চেহারা কঠিন হল। তার বোনের সাথে মাত্র বনিবনা হয়েছে, অথচ তা কত ভঙ্গুর…তাকে আরো সাবধান হতে হবে যাতে এই সম্প্রীতিটা নষ্ট না হয়। অথচ তিনি আওরঙ্গজেবের বিচার বিবেচনাকে চ্যালেঞ্জ করছেন–যা আর কেউ করার সাহস করবে না। আর তার এই সিদ্ধান্তে তিনি কাউকেই নাক গলাতে দেবেন না, এমনকি জাহানারাকেও নয়।
তিনি শান্তভাবে বললেন, আমি আপনার সাথে একমত নই। আমি চাই এমনভাবে আমার ক্ষমতা প্রকাশ করবো যেন কেউ তা উপেক্ষা করতে না পারে। যাতে তারা বুঝতে পারে যে, শিবাজির সাথে বিদ্রোহে সামিল হলে আমার প্রতিশোধ কিরকম প্রবল হতে পারে। আপনি একজন নারী এবং দীর্ঘদিন নির্জনে জীবন-যাপন করেছেন। সাম্রাজ্য শাসনের বাস্তবতা আর শত্রুর মনমেজাজ আপনি কি আমার মতো বুঝতে পারবেন?
জাহানারা বললেন, আমি ঠিকই বুঝি! আমি কি বাবাকে একসময় রাষ্ট্রের কাজে সহায়তা করি নি? তিনি কি আমার মায়ের নামাঙ্কিত সিলমোহর আমার হাতে তুলে দেননি, যা দিয়ে আমি ফরমান জারি করতে পারতাম? তিনি কি মাঝে মাঝে আমার পরামর্শ চেয়ে তা আমলে নেন নি?’ এক মুহূর্তের জন্য তাঁর চোখদুটো জ্বলে উঠলো, তারপর আবার বললেন, “তোমাকে সাবধান না করলে, আমি আমার বাবা আর পূর্বপুরুষদের প্রতি আমার কর্তব্য পালনের দায়িত্বে ব্যর্থ হব। আর যদি তোমার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার করার বিষয়ে তুমি নিজের অবস্থানে অনড় থাকো, তাহলে মোগলরা এতদিন সংগ্রাম করে যা গড়ে তুলেছিল তা অস্থির, হয়তো ধ্বংস করে ফেলবে। এতকাল যেখানে কোনো বিভেদ ছিল না, এখন তা গড়ে উঠবে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলতে থাকবে। তাদের ধর্মের প্রতি বৈষম্য দেখিয়ে তাদেরকে দূরে ঠেলে দেওয়ার পরিবর্তে অভিজাত হিন্দু পরিবারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তুলে আমরা কি হিন্দুস্তানে আমাদের অবস্থান সংহত করে তুলি নি? তাদের রক্ত কি আমাদের ধমনিতে বইছে না–তোমার ছেলের ধমনিতে কি নেই? একজন রাজপুত অভিজাত নারীর গর্ভে কি তোমার একটি পুত্র সন্তান নেই? এজন্য কি মুয়াজ্জমকে তুমি অন্যদের চেয়ে কম ভালোবাস? একজন মানুষের ধর্মের দিকে না তাকিয়ে আমাদের রাজবংশ আর সাম্রাজ্য কি উন্নতি লাভ করে নি?’
‘আপনি আপনার উদার সুফি বিশ্বাসে অতিরিক্ত প্রভাবিত হয়েছেন। আপনি এটাকে আপনার জন্য উপযুক্ত দর্শন মনে করতে পারেন, তবে এগুলো আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস উৎপাদন করা থেকে অনেক দূরে রয়েছে।’
‘হ্যাঁ, আমি একজন সুফি। সব সময়ই তা থাকবে আর এটাই আমাকে সহনশীল হতে আর অন্যকে শ্রদ্ধা করতে শেখায়। তবে শুধু একারণেই আমি তোমাকে একাজ থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করছি না। আমি তোমাকে এসব বলছি কেননা এটা আমাদের শাসন কাজ চালিয়ে যাবার ব্যাপারে অনেক বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে। আওরঙ্গজেব, তোমাকে কে এই পরামর্শ দিয়েছে? উলেমারা দিয়েছে? আমার মনে হয় মোল্লারা তোমার আর তোমার রাজত্বের ভালো করার বদলে নিজেদের ক্ষমতার ব্যাপারটি নিয়ে বেশি ভাবে।