একজন তরুণ মোল্লা জিজ্ঞেস করলো, ‘সবকটি নিশ্চয়ই নয় জাহাপনা?’ সাথে সাথে আবু হাকিমের ঘন ভ্রুর নিচ থেকে কড়া চোখে তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাতেই সে বুঝতে পারলো সম্রাটের কথার মাঝে কথা বলে সে ভুল করেছে। এখন সে চোখ নামিয়ে সোজা কার্পেটের দিকে তাকিয়ে রইল।
‘ভালো প্রশ্ন করেছেন, অবশ্যই সবকটি নয়। সবকটি ধ্বংস করার চেষ্টা করাটা অবাস্তব আর অবিজ্ঞ হবে। আমি প্রথমে মথুরার মন্দিরটা দিয়ে শুরু করতে চাই, এটা হিন্দুদের একটা প্রধান তীর্থকেন্দ্র আর এখান থেকেই লোকজনের অসন্তুষ্টির খবর এসেছে আর ওখানে খাজনা আদায় করতে গিয়ে আমার লোকেরা ওদের হাতে নাজেহাল হয়েছে। এতেও যদি প্রজারা আমার কর্তৃত্ব ক্ষমতার প্রতি নত না হয় তাহলে ওদেরকে শিক্ষা দেবার জন্য আমি আরো মন্দির বেছে নেব। হয়তো নতুন কিংবা মেরামত করা মন্দিরগুলো বেছে নেব। আর পার্থিব অর্থে আমার শাসন এবং আমাদের নিজ ধর্মের প্রাধান্য প্রমাণ করতে যেসব মন্দির ভেঙ্গে ফেলা হবে সেসব জায়গায় নতুন নতুন মসজিদ নির্মাণ করা হবে।’
আওরঙ্গজেব একটু থেমে তাঁর কথার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করলেন। তার কথায় উলেমারা একটু অবাক হলেও তাদের মুখের ভাব দেখে বুঝা গেল ওরা কতটা তার কথায় সায় দিয়েছে। তিনিই প্রথম মোগল সম্রাট, যিনি তাঁর ধর্মকে শাসন কাজে ব্যবহার করছেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা, যত বড়ই হন না কেন, সবাই আপস করেছিলেন। কেউ কেউ, বিশেষত আকবর–এমনভাবে কাজ করেছিলেন যেন, তাঁদের প্রকৃত কোনো ধর্ম মোটেই ছিল না। অন্যরা পার্থিব জীবনে ধর্মকে উপেক্ষা করে কেবল মুখে মুখে ধর্মবিশ্বাসের কথা বলেছিলেন। এরা ব্যক্তিগত জীবনে মদ, আফিম আর অন্যান্য আমোদপ্রমোদে ব্যস্ত ছিলেন। তরুণ বয়সে তিনি এ ধরনের আচরণ লক্ষ করেছিলেন, যখন তাঁর পিতামহ জাহাঙ্গীর আর তাঁর বাবা শাহজাহানের মধ্যে লড়াই চলছিল, তখন তাঁর পিতামহ জাহাঙ্গীর, শাহজাহান ভবিষ্যতে ভালো ব্যবহার করবেন এই আশায় তাকে আর দারা শিকোহকে জিম্মি করে রেখেছিলেন। রাতের পর রাত পিতামহের তত্ত্বাবধানে থাকার সময় তারা দেখেছেন, সম্রাজ্ঞী নূরজাহান মদের গ্লাসে আফিমের বড়ি মিশিয়ে দিচ্ছেন। আর প্রতি চুমুকের সাথে জাহাঙ্গীর তাঁর ধর্মকে অমান্য করেছেন, সুরার প্রভাবে তার মাথা ঘুলিয়ে গিয়েছিল আর তার নামকাওয়াস্তে কুচক্রী স্ত্রীকে সাম্রাজ্য শাসন করার অনুমতি দিয়ে সাম্রাজ্যকে বিপন্ন করে তুলেছিলেন।
তিনি আবার বললেন, আমার আরো কিছু বলার আছে। আমি যদি আমার প্রজাদের সামনে আমাদের ধর্মবিশ্বাস আর সেই সাথে আমার কর্তৃত্বের প্রাধান্য তুলে ধরতে চাই, তাহলে আমার নিজেকেও ব্যক্তিগতভাবে ধর্মের প্রতিটি আচার-আচরণ পালনে লোকজনের সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকতে হবে।’
আবু হাকিম বললেন, কিন্তু জাহাপনা, এই দুনিয়ায় আপনার চেয়ে ধর্মভীরু– এবং নিয়ম-কানুন নিষ্ঠার সাথে পালন করে এমন মুসলিম সন্তান আর কেউ নেই।’
‘আপনি ভুল বলেছেন। একটি দৃষ্টান্ত রাখার জন্য আমাকে আরো কিছু অবশ্যই করতে হবে। আমি জানি যে, অনেক সময় আমি বেশ অসতর্ক হয়ে পড়ি। দৃষ্টান্তস্বরূপ যেমন, সংগীতের প্রতি আমার অনুরাগ আমার মনকে আমার দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। শক্তির অপচয় হয় এবং আমাকে আলসে করে দেয়। কাজেই এখন থেকে আমি রাজদরবারে বাদ্যযন্ত্র বাজানো নিষিদ্ধ করতে চাই। এছাড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কোনো উপলক্ষ ছাড়া দামি পোশাক আর রত্নালংকার ব্যবহার করবো না আর সভাসদদেরও তা করতে বোঝাবো। এই ধরনের অলঙ্করণ অতিমাত্রায় ব্যক্তিগত অহঙ্কার আর অসার দম্ভের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই না, আর এটা আধ্যাত্মিক জীবন যাপন থেকে আমাদেরকে বিচ্যুত করে দেয়। আর আমি আমার জীবনের কালানুক্রমিক ঘটনাপঞ্জি লিপিবদ্ধ করার গোমর দেখানোর নিয়ম থেকে দরবারের লিপিকারকে বিরত করতে চাই। আমার বিচারক হচ্ছেন আল্লাহ, যার এ ধরনের লেখ্য প্রমাণের প্রয়োজন নেই, তাই আমারও নেই। আপনাদের আর যদি কিছু বলার না থাকে তাহলে আপনারা এখন আসতে পারেন। ফরমানগুলো তৈরি হবার পর আবার আপনাদের তলব করবো, যাতে আমরা সবাই আবার আলোচনা করবো কিভাবে আমার পরিকল্পনা কাজে লাগানো যায়।’
সন্ধ্যায় কামরায় একাকী বসে আওরঙ্গজেব একটু পরিতৃপ্তি অনুভব করলেন। শিবাজির পলায়নের ঘটনাটি এখনও তার মনে পীড়া দিচ্ছে, তবে এটা হয়তো একটি আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। কেননা এটা তার দর্পচূর্ণ করে দিয়ে তাঁকে কঠিন সিদ্ধান্ত নেবার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাছাড়া সংগীত সুখ বিসর্জন দেবার মতো শক্তি খুঁজে পেয়ে তিনি খুশি হয়েছেন। পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা আর দরবারের ঘটনাপঞ্জি লিপিবদ্ধ পরিত্যাগ করার তুলনায় এটা করতে তাঁর অনেক চেষ্টা করতে হয়েছে। আর একবার জনসমক্ষে ঘোষণা দেওয়ার পর আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। তবে অন্যরকম বৈধ আনন্দের উৎস এখনও আছে তার কাছে। একটু পর তিনি উদিপুরী মহলের কাছে যাবেন…তবে একজন কোরচি হঠাৎ উদয় হয়ে তাঁর এই সুখ-ভাবনায় ছেদ ঘটাল।
‘জাঁহাপনা, শাহজাদি জাহানারা বেগমসাহিবা এসেছেন। তিনি আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাচ্ছেন।’