মারাঠি নেতার কথা মনে পড়তেই তার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। তিনি কল্পনা করলেন, পালিয়ে যাওয়ার পর সে উল্লাস করছে …আত্মতৃপ্তির হাসি দিয়ে আর গর্ব করে তার অনুসারীদের কাছে বর্ণনা করছে কিভাবে মোগলদেরকে বুদ্ধির খেলায় বোকা বানিয়েছে। ঠিক আছে, সে, তার অনুসারী আর অন্যান্য যারা একই ধর্মবিশ্বাসী তারা সবাই এই স্পর্ধা দেখানোর কারণে অনুতপ্ত হবে।
*
দুইদিন পর ফজরের নামাজের পর আওরঙ্গজেব দেওয়ান-এ-খাসে এলেন। সেখানে তার অনুরোধে ধর্মীয় উপদেষ্টা, উলামারা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কালো আলখাল্লা পরা কালো দাড়িওয়ালা মোল্লারা তাকে দেখে মাথা নুইয়ে অভ্যর্থনা জানাতেই তিনি তাদেরকে বসতে ইঙ্গিত করলেন। তাঁকে ঘিরে অর্ধবৃত্তাকারে ওরা ভারী লাল-নীল কার্পেটের উপর বসলেন।
আপনারা তো জানেন যে, রাজদ্রোহী মারাঠি নেতা শিবাজি পালিয়েছে। তার পলায়ন আমার আর আমার সাম্রাজ্যের জন্য একটি অবমাননার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্যই আমি আপনাদেরকে এখানে আসতে আহ্বান জানিয়েছি। সমস্ত রাজদ্রোহী আর অসন্তুষ্ট ব্যক্তিরা এখন শিবাজিকে মোগল শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একজন বিজয়ী ব্যক্তি মনে করবে। এছাড়া ওদের মধ্যে যারা বিধর্মী তারা এই বিষয়টি তুলে ধরবে যে, তারা সবাই একই ধর্মবিশ্বাসী আর তার পলায়নে মন্দিরের পুরোহিতরা যে সাহায্য করেছে সেকথাটিও বলবে। আর এসব কথা বলে ওরা অন্য হিন্দুদেরকেও বিদ্রোহে সামিল হতে আহ্বান জানাবে। আমি এটা হতে দেবো না। অনেক চিন্তাভাবনার পর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, এখন সময় এসেছে সেই কাজটি করার, যা আমরা প্রায়ই আলোচনা করেছি। আপনাদের মধ্যে অনেকেই যে কাজটি করার জন্য প্রায়ই আমাকে চাপ দিতেন, তা হল–হিন্দু প্রজাদেরকে আমার ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব দেখানো। আমি তাদেরকে দেখাতে চাই, তাদের ধর্মের উপর বিধিনিষেধ কম আরোপ করে মোগলরা কতটুকু সহনশীলতা আর মহানুভবতা দেখিয়েছেন। তবে তারা যদি আমার বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহে সমর্থন করে তাহলে আরো কঠিন বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে।’
অনেক মোল্লা মাথা নেড়ে সায় দিলেন। আবার কেউ কেউ তাদের নেতা হিরাত থেকে আগত আলেম, সাদা দাড়িওয়ালা আবু হাকিমের দিকে তাকালেন। তিনি হাত তুলে বললেন, ‘আমি কী একটা কথা বলতে পারি, জাহাপনা?
‘অবশ্যই বলুন, আবু হাকিম।’
‘আপনার কথা আমাদেরকে আনন্দ দিয়েছে আর এ থেকে আপনার বিস্তৃত এবং গভীর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেখছি যে, কাফেররা কিভাবে আপনার মহান পূর্বপুরুষ, আল্লাহ তার বেহশত নসীব করুন–সম্রাট আকবরের কাছ থেকে পাওয়া স্বাধীনতা আর সমযোগ্যতা থেকে অন্যায় সুবিধা নিচ্ছে। হিন্দু ধর্ম’টির, যদি আমরা এটাকে একটা ধর্ম বলেই থাকি, এর যারা পৌরহিত্য করে থাকেন, তারা হচ্ছে বাঁচাল ধরনের কিছু পুরোহিত। আমি যতদূর খবর পেয়েছি, তা থেকে জানতে পেরেছি, ওরা মনে করে ধূপ-ধুনার ধোঁয়ায় আধো-অন্ধকার মন্দিরগুলো ওদের জন্য নিরাপদ আর সেখান থেকেই ওরা আপনার আশীর্বাদ ধন্য শাসনের বিরুদ্ধে মানুষজনকে ক্ষেপিয়ে তোলার মতো হঠকারিতা করছে। মোগলদেরকে ওরা ভিনদেশি হানাদার হিসেবে অভিযুক্ত করে আর দাবি করে যে, হিন্দু প্রজাদের উপর আপনার কোনো আইনগত কর্তৃত্ব নেই, যাদেরকে আপনি এবং আপনার পূর্বপুরুষরা তাদের মাটি থেকে অধিকারচ্যুত করেছেন। তাদের উপর করারোপ করা কিংবা তাদেরকে শাস্তি দেবারও কোনো অধিকার আপনার নেই, কাজেই ওরা আপনার হুকুম এবং কোনো তলব মানতে বাধ্য নয়। অবশ্যই আমরা সকলে এই জঘন্য মানুষগুলোকে আপনার ক্ষমতা আর শাসনের বদান্যতা বুঝাতে মহামান্য জাহাপনাকে যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। আর এর মধ্য দিয়ে আমাদের ধর্মের বদান্যতাও শিক্ষা দেবো, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছেন আপনি।
মাথা নিচু করে লোকটির কথাগুলো শুনতে শুনতে আওরঙ্গজেব ভাবছিলেন, আবু হাকিম একজন বাঁচাল আর অতিবিগলিত মোসাহেব, নিজের কণ্ঠস্বর শুনে সে নিজেই ধন্য হচ্ছে। বেশিরভাগ সময় তার দীর্ঘ এবং গুরুভার নসিহতগুলো বিশ্বাসীদের অনুপ্রাণিত করার বদলে নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করার উদ্দেশ্যে করা হত। তবে তাকে উলেমাদের প্রধান নিযুক্ত করার সময় আওরঙ্গজেব বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। সম্রাটের মনের ইচ্ছা আগাম . ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন এবং তার বৈধতা দানের জন্য নিজে নিজেই যথাযত ধর্মীয় যুক্তি খুঁজে বের করতে পারেন। এই আবু হাকিমই তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, খারেজি দারাকে ফাঁসি দিয়ে তিনি আল্লাহর কাজই করছেন আর এই কাজের জন্য নরকপ্রাপ্তির বদলে বরং তাকে পুরস্কৃত করা হবে।
‘ধন্যবাদ আবু হাকিম। খুবই ভালো হয় যদি আপনি আর অন্যান্য উলেমারা আমার সাম্রাজ্যের সকল মসজিদ, মাদ্রাসায় আপনাদের ভাইদেরকে বুঝান, যেন তারা ওয়াজ-নসিহত করার সময় আমার শাসনের আইনানুগ এবং সদাশয় দিকটি এবং আমাদের ধর্মের সঠিক পথে এর আনুগত্যের কথাটিও তুলে ধরেন। আমার সকল প্রজাদের সামনে আমার কর্তৃত্ব স্পষ্ট করার উদ্দেশ্যে আমি হোলি আর দেওয়ালির মতো হিন্দু উৎসব নিষিদ্ধ করতে রাজকীয় ফরমান জারি করবো। এছাড়া হিন্দুদের পবিত্র স্থাপনাগুলো ধ্বংস করার আদেশ …’