*
আগ্রা দুর্গের বুরুজের উপরে দাঁড়িয়ে আওরঙ্গজেব নিচে কুচকাওয়াজ ময়দানের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। সেখানে পাকানো চাবুক বার বার প্রহরীদের খোলা পিঠের উপর পড়ছিল। ওরা আর্তনাদ করছিল আর ওদের ক্ষতবিক্ষত দেহের নিচে বালু রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছিল। দুই হাত পা দুই দিকে ছড়িয়ে একটা কাঠের ফ্রেমের উপর ক্রুশের মতো শুইয়ে হাত-পা চামড়ার ফিতা দিয়ে বাঁধা ছিল। ওরা টানাটানি করে আপ্রাণ চেষ্টা করছিল হাতপায়ের বাঁধন ছিঁড়তে।
একশো চাবুক মারা হল সঠিক শাস্তি। এই লোকদুটোর দায়িত্বে অবহেলার কারণে মারাঠি নেতা পালাতে পেরেছেন। এর ফলে শিবাজি আবার একজন বীর হবেন আর তিনি নিজে হবেন একজন হাস্যাস্পদ ব্যক্তি। আর শুধু তাই নয়। শিবাজি যে পালিয়েছেন সেটা কেবল আজ সকালে ওরা আবিষ্কার করেছে। অথচ পরিষ্কার গত সন্ধ্যায় তিনি আর তার ছেলে বেশ চতুরতার সাথে প্রতিদিন যে দান সামগ্রী বেতের ঝুড়িতে করে মন্দিরে পাঠাতেন, তার মধ্যে লুকিয়ে পালিয়েছেন। আর তার নায়েব, যে নিশ্চয়ই তার পালাবার সমস্ত ব্যবস্থা করেছিল, সেও গতরাতে চুপিসারে শিবাজির চাকরবাকরসহ পালিয়েছে। আওরঙ্গজেব সাথে সাথে তাদেরকে ধরার জন্য কয়েকজন ঘোড়সওয়াড় পাঠিয়েছিলেন, তবে পলাতকদের ধরার তেমন আশা নেই।
আর্তচিৎকার থেমে গেছে। মন হল প্রহরী দুজন জ্ঞান হারিয়েছে। তারপরও চাবুকমারা চলছে–তিনি হুকুম দিয়েছিলেন যদি ওরা জ্ঞান হারায় তবুও চাবুক মারা চলতেই থাকবে। কাঠের আড়াআড়ি খুঁটি থেকে দেহগুলো এখন কশাইয়ের হুক থেকে ঝুলানো মাংসপিণ্ডের মতো নিস্তেজ হয়ে ঝুলছিল। যদি বেঁচেও থাকে–হয়তো থাকবে–তবে জীবনের বাকি দিনগুলো চাবুকের ঘায়ের ক্ষত বয়ে বেড়াবে। সবসময় মনে থাকবে কিভাবে ওরা দায়িত্ব অবহেলা করেছিল। আর দুর্গের সুবেদার ফাওলাদ খানকে কাবুলে নির্বাসনে পাঠানো হবে।
পেছন ফিরে আওরঙ্গজেব ধীরে ধীরে তাঁর মহলের দিকে হেঁটে চললেন। পরিচারকদেরকে লেসের সুতার তৈরি টাটি পর্দাটি নামিয়ে দিতে বলে তিনি শক্ত মার্বেল পাথরের মেঝেতে হাঁটুগেড়ে বসে প্রায়ান্ধকারে নামাজ পড়া শুরু করলেন। সব সময়ের মতো যখনই আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হন, তখন অনিশ্চিত এই পৃথিবীতে একমাত্র নিশ্চিত এই সত্তাই সান্ত্বনা হয়ে দাঁড়ায়। শেষবারের মতো মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে সেজদার পর যখন উঠে দাঁড়ালেন, তখন অনুভব করলেন তার মন অনেক শান্ত এবং পরিষ্কার হয়েছে। শিবাজি তাকে বোকা বানিয়েছেন। তবে তার পালিয়ে যাওয়ার পেছনে হয়তো কোনো ঐশী উদ্দেশ্য রয়েছে। হয়তো আল্লাহ তাকে সতর্ক করে দিচ্ছেন যে, তিনি একটু বেশি গর্বিত হয়ে যাচ্ছেন, নিজের সক্ষমতা সম্পর্কে বেশি আস্থাবান হয়েছেন এবং এক ও অদ্বিতীয় সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ধর্মীয় রীতিনীতি পালনে অতিরিক্ত ঢিলেমি দিয়েছেন। অবশ্যই এটাই প্রথম নয় যে তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেছেন তিনি কতটুকু ভালো মুসলিম। অনেক সময় যখন রাতে ঘুম আসতো না, তখন তিনি ধর্মবিশ্বাসের প্রতি তাঁর একাগ্রতা প্রমাণের জন্য উপায় খুঁজে বেড়াতেন– আরো মসজিদ নির্মাণ করবেন, গরিবদের উদ্দেশ্যে অনুদান আরো বাড়িয়ে দেবেন, মক্কায় আরো বেশি উপঢৌকন পাঠাবেন…।
তবে এসব কাজ তার মনে আনন্দ এনে দিত। তবে এই প্রথমবার তার মনে হল, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার কাজে তাঁকে তাঁর প্রিয় কিছু কোরবানি দিতে হবে। তবে সেটা কি? নারীর মধ্যে তিনি যে আনন্দ খুঁজে পেতেন? তার বেগমদের মধ্যে দিলরাস বানু অনেক দিন আগে মারা গিয়েছেন আর নওয়াব বাঈয়ের কাছে আকর্ষণ করার মতো তেমন কিছু নেই। তবে রাতের পর রাত উদিপুরী মহলের বাহুর উষ্ণতায় তিনি দুনিয়ার কষ্ট ভোলার চেষ্টা করে চলেছেন। ইন্দ্রিয়পরায়ণ উদিপুরী তার সুগন্ধিময় দেহ দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে জড়িয়ে ধরে যে সুখ দেন, তা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করলে কি আল্লাহর প্রতি তার কর্তব্য সমাধা হবে? না, আল্লাহ নারীকে সৃষ্টি করেছেন একটি উদ্দেশ্যে–পুত্র জন্ম দেবার জন্য। ইতিমধ্যে তাঁর চারটি পুত্রসন্তান হয়েছে, তার মধ্যে মোহাম্মদ সুলতান তার বাবা আর ভাইদের সাথে লড়াই চলার সময় তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যার পরিণতিতে সে বাকি জীবন অন্ধকূপে বন্দী হয়ে কাটাবে। আর বাকি তিনজন–মুয়াজ্জম, আজম আর আকবর বর্তমানে তাদের দোষত্রুটি থাকা সত্ত্বেও ওরা তাঁর গর্ব। তবে কে জানে ভবিষ্যতে কি হবে? যদি ওদের মধ্যেও কেউ বিশ্বাসঘাতক হয়ে দাঁড়ায় কিংবা কোনো একজন যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা অসুখে মারা যায়? সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে হলে তাঁর আরো পুত্রসন্তানের প্রয়োজন; কাজেই এখন যৌনকর্ম থেকে বিরত হওয়ার সময় নয়। তাকে অন্য কিছু ত্যাগ করতে হবে। তার মধ্যে সংগীত হল একটি। তবলা আর সেতারের আওয়াজ সবসময় তাকে ইন্দ্রিয়সুখ দিত, তবে সেটি কি চপলতা এবং স্বার্থপরতা নয়? নিজেকে খুশি করা ছাড়া সংগীতের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। তাকে এটাই ছাড়তে হবে। রাষ্ট্রের কোনো অনুষ্ঠানের প্রয়োজন ছাড়া সুন্দর দামি পোশাক আর রত্নালঙ্কার পরা বাদ দিতে হবে। ঈশ্বরপ্রেমী একজন মানুষের এসব পোশাক পরিচ্ছদের অনাবশ্যক অলঙ্কার কোনো প্রয়োজন নেই। ভবিষ্যতে সরলতাই হবে তার ব্যক্তিগত স্লোগান। তাহলেই আল্লাহ তার বর্জন এবং আত্মত্যাগ অনুমোদন করবেন এবং অবিশ্বাসী শিবাজির বিরুদ্ধে তাঁকে বিজয় এনে দেবেন।