একুজি জিজ্ঞেস করলো, “মহারাজ, মালামালগুলো এসে গেছে। আপনি কি রোজকার মতো দেখে নেবেন?
‘অবশ্যই দেখবো। তবে বাইরের আতশবাজির শব্দ আর হৈহুল্লোরে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। ঝুড়িগুলো বরং ভেতরে আমার কামরায় নিয়ে এসো। নায়েবের পিছু পিছু কুলিরা ঝুড়িগুলো মাথায় করে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। তবে শিবাজি যেখানে ছিলেন, সেখানেই রইলেন, প্রহরীরা কিছু বলে কি-না শোনার জন্য। ঠিক তখনই আরেকটি আতশবাজি ফুটে উঠতেই প্রহরী দুজন শিবাজির দিকে পেছন ফিরে একটা পাথরের বেঞ্চের উপর উঠে দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে আতশবাজির খেলা দেখার জন্য আকাশের দিকে তাকাল।
মোট তিনটি ঝুড়ি ভেতরে কামরায় নেওয়া পর্যন্ত শিবাজি অপেক্ষা করলেন। সেখানে সম্ভাজি তার জন্য অপেক্ষা করছিল। আর একুজি দুই কুলিকে বিদায় করে দিতেই ওরা বাইরে এসে প্রায়ান্ধকার আকাশে আতশবাজির সোনালি রঙের তারা দেখতে লাগলো। নিঃশব্দে তিনি এক থেকে পাঁচশো পর্যন্ত গুণতে শুরু করলেন, এই সময়ের মধ্যে দুটি ঝুড়ি থেকে যথেষ্ট পরিমাণ শুকনো খাবার নামিয়ে একুজি একটা ঝুড়ির ভেতর সম্ভাজিকে ঢুকালো। তারপর শিবাজি উঠলেন এবং নিচু হয়ে স্যান্ডেল থেকে কিছু ধুলা ঝাড়ার ভান করে তারপর ধীরে ধীরে ভেতরের দিকে হেঁটে চললেন।
একুজি ফিসফিস করে বললো, ‘জলদি করুন, মহারাজ!’ শিবাজি দরজার কাছে রাখা খোলা ঝুড়িটার ভেতরে ঢুকলেন। ঝুড়ির ভেতরে গুঁড়িসুরি মেরে বসতেই একুজি তার মাথা, ঘাড়ে রুটি, আর খাবারের প্যাকেট ভরতে শুরু করলো। যতদূর সম্ভব খাবার সামগ্রী দিয়ে তাকে পুরোপুরি ঢেকে ঢাকনিটা বন্ধ করার আগে একুজি কুলিদেরকে ডাকলো, ‘বেয়ারা, এখানে এস!’ তবে বাইরের প্রচণ্ড হট্টগোলের শব্দে কুলিরা তার ডাক শুনতে পেল না। শিবাজি অনুভব করলেন, একুজি তার ঝুড়িটি পাশ কাটিয়ে দরজার কাছে গিয়ে আবার জোরে চিৎকার করে কুলিদের ডাকলো। তারপর আতশবাজির শব্দ হঠাৎ থেমে যেতেই শিবাজি পাথরের মেঝেতে কুলিদের খালি পায়ে হাঁটার শব্দ শুনতে পেলেন। তারপর অনুভব করলেন ঝুড়িটি উপরের দিকে উঠছে, তিনি দুপাশে তার পেশিবহুল দুই হাত ঠেকা দিয়ে বসলেন। কুলিটি ঝুড়িটি মাথায় করে উঠান পার হয়ে নিচে পাথরের মেঝেতে রাখলো। তারপর দুবার ধপ করে শব্দ হতেই বুঝলেন অন্য ঝুড়িগুলোও তার পাশে এসে গেছে।
তিনি শুনলেন একুজি চেঁচিয়ে বলছে, আপনারা কি ঝুড়িগুলোর ভেতরে দেখবেন? আমি কিন্তু এখনও এর মুখ বাঁধিনি।’ শিবাজি চোখ বুজলেন। এত ধীরে কখনও সময় পার হয় নি। তার পিঠ দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরতে লাগলো। সম্ভাজি কিভাবে সামলাচ্ছে কে জানে? সে সাহসি ছেলে, তবে বয়স মাত্র নয় বছর…
কেউ কথা বললো না। ব্যাপার কি? কি হচ্ছে? হয়তো যে কোনো মুহূর্তে ঝুড়ির ঢাকনি খুলে যাবে আর তারপর তিনি অনুভব করবেন একটা আঙুলে খোঁচা মেরে মেরে দেখছে, একসময় তার গায়ে খোঁচা মারবে। তারপর তার চুল ধরে তাকে টেন বের করবে। কিন্তু তারপর আবার আতশবাজি আকাশে উড়লো। প্রায় একই সাথে সাথে এক ঝটকা মেরে ঝুড়িটাও উপরের দিকে উঠলো। শিবাজি আবার চলতে শুরু করেছেন। আতশবাজির নতুন প্রদর্শনীর দিকে অবশ হয়ে তাকিয়ে ওরা হয়তো ঝুড়িগুলো নিয়ে চলে যেতে কুলিদেরকে ইশারা করেছিল। আতশবাজির শা শা আর হিস হিস শব্দ হলেও শিবাজি ওদের হাঁটার ছন্দ বুঝতে পারছিলেন আর গুণতে চেষ্টা করছিলেন কয় পা গেল। আট, নয়, দশ …একজন কুলি বিড়বিড় করে বললো, এই শিবাজি দিন দিন আরো দানশীল হচ্ছেন। আমি শপথ নিয়ে বলবো এই ঝুড়িটা ভীষণ ভারি। কিন্তু ওরা ওদের চলা থামাল না…এগার, বারো, তেরো…এখন মনে হয় ওরা ভেতরের গেটের চৌকাঠের নিচ দিয়ে যাচ্ছে। এখানেই গাধার গাড়িটা অপেক্ষা করার কথা। হাউই বাজির শাঁ শাঁ হিস হিস শব্দের ভেতর দিয়ে কান খাড়া করে তিনি লাগামের মৃদু টুংটাং শব্দটা ঠিকই ধরতে পারলেন। গাধার গাড়িটা এসে গেছে।
ঠিক তখনই কুলি তার ঝুড়িটা মাটিতে ফেলে দিল। এক মুহূর্ত ঝুড়িটা সামনে পেছনে দুলতে লাগলো–যদি উল্টে পড়ে ঢাকনিটা খুলে যায় তাহলে তিনি ধরা পড়ে যাবেন। শিবাজি নিজের দেহ কুণ্ডলি পাকিয়ে শক্তভাবে একটা বলের মতো করে রাখলেন আর আশা করলেন যেন ঝুড়িটার দুলুনি থেমে যায়। একুজি চিৎকার করে উঠলো, এই বুন্ধু সাবধানে রাখ! যদি আমার প্রভুর কাছ থেকে রূপার মুদ্রা পেতে চাও, তাহলে অসাবধান হয়ো না। নাও ঝুড়িটা তোল আবার। ঝুড়িটা আবার উঠলো। যখন অনুভব করলেন গাড়িতে রাখার জন্য ঝুড়িটা আরো একটু উঠলো, তখন শিবাজি বহুকষ্টে একটা বিজয় উল্লাসের চিৎকার দমন করলেন। গাড়িটা যেভাবে তার নিচে পর পর দুবার দুলে উঠলো, তাতে বুঝা গেল তার ঝুড়িটাই প্রথমে তোলা হয়েছে। এক মুহূর্ত পর গাড়োয়ান চাবুক হাঁকাতেই গাড়িটা দুর্গ থেকে বের হওয়ার ঢালু পথ বেয়ে নামা শুরু করতেই শিবাজি টের পেলেন তার ঝুড়িটা সামনের দিকে সামান্য টাল খেল।
সবকিছু ভালোভাবে চললে শীঘ্রই ওরা মন্দিরে পৌঁছে যাবেন। সেখানে পুরোহিত তাকে আর তার ছেলেকে ভবঘুরে ভিক্ষুকের ছদ্মবেশ নিতে সাহায্য করবে। তারপর আগ্রার সরু গলির মধ্য দিয়ে পথ দেখিয়ে শহরের দেয়ালের বাইরে আমবাগানের কাছে নিয়ে যাবেন, যেখানে তার লোকজন ঘোড়া নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। তারপর গরম বাতাসে চুল উড়িয়ে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ওরা দাক্ষিণাত্যের পাহাড়ের দিকে জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে চলবেন।