.
অধ্যায় :৩
আওরঙ্গজেব যে তৈমুরের আংটি পরতেন, সেই তৈমুর (১৩৩৬-১৪০৫) পশ্চিমাবিশ্বে টমবুরলেইন নামে পরিচিত। তৈমুর দি লেইম’ নামটি বিকৃত হয়ে টমবুরলেইন হয়েছে। ক্রিস্টোফার মার্লোর নাটকে তাকে “ঈশ্বরের গজব’ হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে। তিনি একজন বিখ্যাত যোদ্ধা ছিলেন। পশ্চিমা জগতের অধিকাংশ এবং মধ্য এশিয়া তিনি বিজয় করেন। ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিল্লি আক্রমণ করে তছনছ করে দেন। তার রাজধানী সমরকন্দকে সুন্দর করে সাজানার জন্য তিনি এখান থেকে প্রচুর রত্ন এবং কারিগর সাথে নিয়ে ফিরে যান। প্রকৃতপক্ষে তিনি প্রথম মোগল সম্রাট বাবরের একজন পূর্বপুরুষ ছিলেন। চেঙ্গিস খাও তা-ই ছিলেন।
১৬৬৬’র মে মাসে শিবাজি আগ্রা আসেন। আওরঙ্গজেব তাকে বন্দী করে। ওই বছরের আগস্টের শেষে তিনি একটি বেতের ঝুড়িতে লুকিয়ে পালিয়ে যান। আওরঙ্গজেব তার মতো সাধারণ পোশাক পরার অনুশাসন মেনে চলার বিষয়ে তার সভাসদদের উপর কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। একবার একজন সভাসদ একটি পোশাক পরে তার সামনে হাজির হন, যার ঝুল অনেক লম্বা ছিল এবং সম্রাটের চোখে অতি অলঙ্কৃত ছিল। আওরঙ্গজেব সাথে সাথে তার সামনে পোশাকের ঝুল কাটার নির্দেশ দিলেন।
এই সিরিজের আগের পুস্তকগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে, মোগল সম্রাটরা ঝরোকা বেলকনি থেকে প্রজাদের সামনে দর্শন দিতেন। এই প্রথা আওরঙ্গজেব বাতিল করলেন। তিনি এ-ধরনের দর্শন দেওয়াকে সম্রাটকে পূজা করার খুব কাছাকাছি একটি প্রথা মনে করতেন।
তাঁর ধর্মে মানুষ এবং প্রাণীর প্রতিকৃতি আঁকার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করা হলেও, আওরঙ্গজেব ছবি আঁকার অনুমতি দিয়েছিলেন এবং সম্রাটের নিজের আঁকা অপরূপ সুন্দর দু-একটি ক্ষুদ্রাকৃতির চিত্রকর্ম পাওয়া যাওয়ার কথা শোনা গেছে।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের উপর তাঁর ধূর্ত সম্রাজ্ঞী নূরজাহান কিরকম প্রভাব বিস্তার করেছিলেন এবং কিভাবে তিনি তাঁকে আফিম সেবন আর সুরা পানে অভ্যস্ত করে তুলেছিলেন, তা বিশদভাবে এই সিরিজের চতুর্থ পুস্তক–দি টেইটেড থ্রোনে উল্লেখ করা হয়েছে। একইভাবে বর্ণিত হয়েছে–কিভাবে ভবিষ্যতে ভালো আচরণ করার নামে তাঁদের পিতা শাহজাহান তাঁদেরকে জিম্মি করে রেখেছিলেন।
.
অধ্যায় : ৪
আজম এবং জানির বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারি ১৬৬৯। মুয়াজ্জমের জন্ম অক্টোবর ১৬৪৩, আজমের জুন ১৬৫৩ এবং আকবরের সেপ্টেম্বর ১৬৫৭।
আওরঙ্গজেব বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকজন স্ত্রী গ্রহণ করেছিলেন। এই কাহিনিতে তিনজনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন–দিলরাস বানু, নওয়াব বাঈ এবং উদিপুরী মহল। দিলরাস বানু ছিলেন পারস্যের সাফাভিদ রাজবংশের একজন শাহজাদী। তিনি ছিলেন শাহজাদি জেবুন্নিসা এবং জাবতুন্নিসার মাতা, যাদের কথা এই পুস্তকে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া তিনি শাহজাদা আজম ও আকবরেরও মাতা ছিলেন। অক্টোবর ১৬৫৭ পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তিনি আকবরকে জন্ম দেবার একমাস পর মৃত্যুবরণ করেন। সম্ভবত প্রসবকালীন কোনো জটিলতা হয়েছিল। একজন কাশ্মিরি রাজকুমারী-নওয়াব বাঈ ছিলেন শাহজাদা মুয়াজ্জম ও মোহাম্মদ সুলতানের মাতা, যাকে তার পিতা কারারুদ্ধ করে রেখেছিলেন। তিনি ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।
উদিপুরী মহলের বংশ সম্পর্কে বেশ কয়েকটি বর্ণনা রয়েছে। আমি সেই ভাষ্যটি অনুসরণ করেছি, যাতে বলা হয়েছে–তার জন্ম ককেশাস পর্বত এলাকার প্রাচীন জর্জিয়া রাজ্যে। আরো অনেক বিশিষ্টতার মধ্যে দাবি করা হয়–এরাই প্রথম মদ আবিষ্কার করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ অব্দে এখানে প্রথম মদ চোলাই করা হয়। উদিপুরী মহল সম্পর্কে অন্যান্য বিবরণে জানা যায়– তিনি যোধপুর অথবা কাশ্মির থেকে এসেছিলেন। দিলারা বানুর মৃত্যুর পর তিনি আওরঙ্গজেবের প্রিয়তমা স্ত্রীতে পরিণত হন।
আওরঙ্গজেব যেসব উল্লেখযোগ্য ভবন নির্মাণ করেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল–আওরঙ্গাবাদে দিলরাস বানুর জন্য নির্মিত বিবি কা মকবরা’ নামে একটি সমাধিসৌধ। এর সাথে তাজমহলের কিছুটা মিল রয়েছে। এই ভবনের নকশার পরিকল্পনা অনুমোদন করার সময় আওরঙ্গজেব সম্ভবত তাঁর প্রিয় মাতা মমতাজের সমাধির কথা বিবেচনা করেছিলেন। নকশাটি তৈরি করেছিলেন ওস্তাদ আহমেদ লাহোরীর পুত্র আতাউল্লাহ। ওস্তাদ আহমেদ লাহোরী তাজমহলের প্রধান নকশাকার হিসেবে স্বীকৃত।
সম্ভবত সর্বাধিক সুন্দর যে ভবনটি আওরঙ্গজেব নির্মাণ করেছিলেন, সেটি হল মোতি মসজিদ। নিজের ব্যবহারের জন্য দিল্লির লাল কেল্লার ভেতরে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে এটি তিনি নির্মাণ করিয়েছিলেন। আমি প্রথম যখন ভারত ভ্রমণে গিয়েছিলাম, তখন সহজেই এই মসজিদে যাওয়া যেত। এটি সত্যিই চমৎকার একটি স্থাপনা।
আওরঙ্গজেব যেসব ধর্মীয় বিধান বলবৎ করেছিলেন, তা এরালি রচিত দি মোগল থ্রোন পুস্তকে বর্ণিত হয়েছে। জাহানারা এর প্রতিবাদ করেছিলেন। গোকলার অভ্যুত্থান হয় ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে এবং তার ভয়াবহ পরিণতি হয়। এই লড়াইয়ে আওরঙ্গজেবের অংশগ্রহণের বিষয়টি কাল্পনিক।
মানুসি এবং বেরনিয়ার উভয়েই রওশনআরার মদ পান এবং প্রণয়ঘটিত ব্যাপারটি বর্ণনা করেছিলেন। তাদের মতে একবার তিনি গোপন প্রেমিকসহ ধরা পড়েছিলেন। এই প্রেমিকদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। উদিপুরী মহলের গর্ভে কমবখশের জন্ম হয় মার্চ ১৬৬৭ খ্রি.।