আওরঙ্গজেব অত্যন্ত সাধারণ একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জুলাই ১৬৫৮ সিংহাসনে আরোহণ করেন। পরবর্তীতে দিল্লিতে ১৫ জুন, ১৬৫৯ অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে তাঁর অভিষেক হয়।
শাহজাহানের বন্দী হয়ে কারাগারে থাকার প্রথম বছরে পিতা-পুত্রের মধ্যে পত্র বিনিময় হয়। শাহজাহানের তরফের চিঠিগুলো কেবল ভর্ৎসনায় পরিপূর্ণ ছিল আর আওরঙ্গজেব তার চিঠিতে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর কাজের স্বপক্ষে যুক্তি দেখান। একটি চিঠিতে আওরঙ্গজেব সরাসরি মূলে চলে আসেন। একজন অবহেলিত সন্তানের গভীর দুঃখ নিয়ে তিনি লিখেন, জাঁহাপনা, আমি স্থির নিশ্চিত ছিলাম যে, আপনি আমাকে ভালোবাসেন না। তিনি শাহজাহানকে নিজের ভ্রাতৃহত্যার জন্য বিদ্রূপ করেন। আমার মনে হয় আরঙ্গজেবের বিশ্বাস যে, তাকে তার পিতা ভালোবসেন না আর মাকে হারাবার শোকই তার চরিত্রের মূল চাবিকাঠি।
জানুয়ারি ১৬৬৬ শাহজাহান শেষবারের মতো আগ্রা দুর্গে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কোনো কোনো বর্ণনা মতে, তিনি যখন বুঝতে পারলেন যে, তিনি মারা যাচ্ছেন তখন তিনি তাঁকে কাছের বেলকনিতে নিয়ে যেতে বললেন, যাতে সেখান থেকে সহজে তাজমহল দেখতে পারেন। সেখানেই কাশ্মিরি শাল গায়ে জড়িয়ে, পাশে ক্রন্দনরত জাহানারাকে নিয়ে তিনি ২২ জানুয়ারি ১৬৬৬ ভোরে মারা যান। পরিচারকরা কর্পূরের পানিতে তাঁকে গোসল করাল, তারপর মলিন কাফনে তার দেহ জড়িয়ে একটি চন্দনকাঠের কফিনে শোয়াল। পরদিন সকালে নিচের তলায় একটি নতুন ফটক খুলে প্রথানুযায়ী আগে মাথা দিয়ে তাঁকে নদীর তীরে নিয়ে যাওয়া হল। তারপর গুটিকয়েক শবানুযাত্রীসহ নৌকাবেয়ে যমুনা নদী পার হল।
জাহানারা জাঁকজমক এবং যথাযথ সম্মানের সাথে তাঁর পিতাকে দাফন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেন নি। আওরঙ্গজেব রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁকে দাফনের অনুমতি দেন নি। দোয়া পড়ার সাথে সাথে বৃদ্ধ সম্রাটের মৃতদেহ অত্যন্ত দ্রুত এবং নীরবে তাজমহলের ভূগর্ভস্থ মার্বেল পাথরের কক্ষে মমতাজের পাশে সমাহিত করা হয়। আমার বিশ্বাস শাহজাহান তার নিজের জন্য যমুনার অপর পাড়ে মাহতাব বাগ নামে একটি সুন্দর চন্দ্রালোকিত বাগানে আলাদা একটি চমৎকার সমাধিসৌধ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন।
১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি দখলের সময় পারস্যসম্রাট নাদির শাহ ময়ূর সিংহাসন তুলে পারস্যে নিয়ে যান। তারপর এটি অদৃশ্য হয়ে যায়, সম্ভবত সেটা ভেঙ্গে ফেলা হয়। পরবর্তীতে পারস্যসম্রাটরা যে ময়ূর সিংহাসনে বসতেন সেটা ১৯ শতকে নির্মাণ করা হয়। এর সাথে মোগল ময়ূর সিংহাসনের কোনো সম্পর্ক নেই। এছাড়া নাদির শাহ মোগল কোষাগার থেকে বিখ্যাত কোহিনূর হীরাটিও তার সাথে নিয়ে যান। এই হীরা গোলকুন্ডার হীরার খনি থেকে উত্তোলন করা হয়েছিল। ১৯ শতকের শেষ দিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় হীরা আবিষ্কৃত হওয়ার আগপর্যন্ত গোলকুন্ডাই একমাত্র হীরার খনি ছিল। কথিত আছে, গোয়ালিয়রের রাজপরিবারের সদস্যরা এই হীরাটি ভবিষ্যৎ সম্রাট হুমায়ুনকে দিয়েছিলেন। পানিপথের যুদ্ধে প্রথম মোগল সম্রাট বাবর যখন উত্তর-পশ্চিম ভারত দখল করে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করছিলেন, তখন গোয়ালিয়রের রাজা পরাজিত পক্ষের হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত হন। পরবর্তীতে হুমায়ুন রাজপরিবারের সাথে ভালো ব্যবহার করায়, কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হীরাটি তাঁর হাতে তুলে দেন। এই সিরিজের দ্বিতীয় পুস্তক ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার-এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, পরবর্তীতে হুমায়ুন হীরাটি পারস্যের শাহের হাতে তুলে দেন, যাতে সিংহাসন পুনরুদ্ধারের সময় তিনি পারস্যের সমর্থন পান। তারপর অবশ্য রত্নটি আবার হিন্দুস্তানে ফিরে আসে এবং শাহজাহানের রত্ন ভাণ্ডারে স্থান পায়। ফরাসি রত্নকার টেভ্যরনিয়ের এটা সেখানে দেখে এর প্রশংসা করেন। নাদির শাহই এই রত্নটির নাম রাখেন কোহিনূর-’জ্যোতির পর্বত’। নাদির শাহ নিহত হওয়ার পর একজন পারসিক সেনাপতি হীরাটি আফগানিস্তানে নিয়ে যান। সেখানে তিনি নিজেকে একজন শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯ শতকের প্রথম দিকে তার একজন বংশধর শাহ শুজাহ পলাতক অবস্থায় থাকাকালে হীরাটি পাঞ্জাবের শাসক রণজিত সিংকে দেন। রণজিত সিং তার ব্রেসলেটে হীরাটি পরতেন। ব্রিটিশরা পাঞ্জাব দখল করার পর গভর্নর-জেনারেল হীরাটি রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে পাঠিয়ে দেন, তারপর সেটি ব্রিটিশ রাজার মুকুটের একটি অংশে পরিণত হয়।
৪ এপ্রিল ১৬৪৪ এক দুর্ঘটনায় জাহানারার মুখ ভীষণভাবে আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। তার মুখের পোড়া দাগটির কথা আওরঙ্গজেবের তখনও মনে ছিল। শাহজাহানের একটি ঘটনাপঞ্জিতে বিষয়টি এভাবে তুলে ধরা হয়েছে :
…কামরার মাঝখানে মাটিতে রাখা একটি জ্বলন্ত প্রদীপের সাথে তাঁর পোশাকের আঁচল ঘষা লাগলো। রাজপ্রাসাদের মেয়েদের পোশাক অত্যন্ত সূক্ষ্ম কাপড় দিয়ে তৈরি করা হত আর তাতে সুগন্ধি তেল মাখা হত। কাজেই তার পোশাকে আগুন লাগবার সাথে সাথে পুরো দেহের পোশাকে আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়লো। তার কাছেই চারজন পরিচারিকা ছিল, তারা সাথে সাথে আগুন নেভাতে চেষ্টা করলো। তবে পুরো পোশাকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকায় ওদের চেষ্টায় কোনো কাজ হল না। পুরো ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটেছিল যে, কাউকে জানিয়ে পানি আনার আগেই আমার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রিয়জনের পিঠ হাত আর শরীরের দুইপাশ ভয়ঙ্করভাবে পুড়ে গেল।