ফারসি ভাষায় লেখা আওরঙ্গজেবের কিছু চিঠি সংরক্ষিত এবং অনূদিত হয়েছিল। আওরঙ্গজেবের শাসনামলে কয়েকজন ইউরোপীয় পর্যটক ভারতীয় উপমহাদেশ সফর করেছিলেন। তারা মোগল সাম্রাজ্য সম্পর্কে তাদের ধারণার কথা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এদের মধ্যে নিকোলো মানুসি স্টোরিয়া দ্য মোগল নামে একটি রঙিন খোশগল্পের মতো কাহিনি রচনা করেছিলেন। মানুসি ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে তার মৃত্যু ১৭১৭ সালে পর্যন্ত ভারতবর্ষে ছিলেন। এছাড়া ফ্রান্সিস বারনিয়ার নামে একজন ফরাসিও রচনা করেন, ট্রাভেলস ইন দ্য মোগল এম্পায়ার এবং জিন-ব্যাপিস্ট রচনা করেন ট্রাভেলস ইন ইন্ডিয়া। ১৭ শতকের শেষ দিকে মোগল সাম্রাজ্যে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যর উইলিয়াম নরিস বেশকিছু অপ্রকাশিত দিনলিপি লেখে যান, যার কিছু অংশ নিয়ে এইচ দাস রচনা করেন দি নরিস এম্ব্যাসি টু আওরঙ্গজেব।
আমার নিজের গবেষণা ছাড়াও আমি আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিশিষ্ট ভারতীয় ঐতিহাসিক আব্রাহাম এরালির দি মোগল গ্রেন থেকে প্রচুর বিষয়বস্তু ব্যবহার করেছি আর সেই সাথে ব্যামবার গ্যাসকোইনের দি গ্রেট মোগল, ওয়াল্ডেমার হ্যাঁনসেনের দি পিকক থ্রোন এবং কেমব্রিজ হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ার সাহায্য নিয়েছি।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে অধিকাংশ চরিত্র ইতিহাস থেকে নেওয়া হয়েছে। তবে বেশ কয়েকজন, যেমন–আমবারের জগিন্দর সিং, ওয়াজিম খান, উমর আলি, ইউসুফ খান, কামরান বেগ, রশিদ খান এবং বিবিধ গভর্নর ও অতি সাধারণ কিছু চরিত্র মূলত জনগণের অংশ কিংবা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। একই কথা নিকোলাস ব্যালেনটাইন আর আমবারের অশোক সিং সম্পর্কেও বলা যায়। এদেরও সম্পর্কে এই পুস্তকে খুব সামান্য উল্লেখ করা হলেও এই সিরিজের অন্যান্য পুস্তকে এরা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলেন।
আওরঙ্গজেব একজন গোঁড়া সুন্নি মুসলমান ছিলেন। অবশ্য তার ধর্মীয় কর্মসূচিগুলো বিশেষভাবে বিতর্কিত ছিল। কোনো কোনো লেখক যুক্তি দেখিয়েছেন যে, হিন্দু ধর্ম এবং মন্দির বিষয়ে আওরঙ্গজেবের কর্মসূচিগুলো মূলত রাজনৈতিক বাস্তবধর্মিতা দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল এবং এগুলো পরিকল্পনা করা হয়েছিল মুখ্যত রাজনৈতিক সার্বভৌম ক্ষমতা জাহির করার উদ্দেশ্যেই। তারা বলেন যে, তাঁর জীবনের অন্য সময়ে তিনি হিন্দু মন্দিরের জন্য জমি প্রদান করেছিলেন। রাজপুতদের বিরুদ্ধে তিনি অনেক পদক্ষেপ নেন নি। তাদের বিরুদ্ধে তিনি যেসব অভিযান করেছিলেন, সেগুলো ধর্মীয় কারণে নয়, সম্ভবত তাদের সময়গত ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছে থেকেই করেছিলেন। এটি অবশ্যই সত্যি যে দ্রষ্টব্য এরালি, পৃ. ৪০১] বিখ্যাত এবং ধৈর্যশীল সম্রাট আকবরের তুলনায় আওরঙ্গজেব অনেক বেশি হিন্দু কর্মকর্তাকে চাকরি দিয়েছিলেন। তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল কেন তিনি এত শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়কে নিয়োগ দিয়েছেন, এর উত্তরে তিনি যথেষ্ট সহনশীলতা দেখিয়ে বলেছিলেন, “জাগতিক বিষয়ের সাথে ধর্মের কী সম্পর্ক?…আপনার কাছে আপনার ধর্ম আর আমার কাছে আমার ধর্ম। দপ্তর থেকে দক্ষ কর্মকর্তা। সরানো বিজ্ঞজনেরা অনুমোদন করেন না।
এই যুক্তির বিপরীতে অনেক ঐতিহাসিক আওরঙ্গজেবের অনেক পক্ষপাতমূলক রাজ্যশাসন প্রণালির কথা তুলে ধরেন। ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল তিনি বিধর্মীদের উপর জিজিয়া কর পুনরায় চালু করেন যা, সম্রাট আকবর মওকুফ করেছিলেন। তিনি নতুন এবং সম্প্রতি পুননির্মিত হিন্দু মন্দিরগুলো ধ্বংস করার আদেশ দেন। তিনি হোলি এবং দিওয়ালির মতো উৎসব নিষিদ্ধ করেন এবং এরালির বর্ণনা অনুযায়ী–অনুমতি ছাড়া হিন্দুদের পালকি ও আরবি ঘোড়া ব্যবহারের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।
তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাসে একজন খাঁটি মানুষ হিসেবে আমি আওরঙ্গজেবের চরিত্র চিত্রণ করেছি এবং বিশেষত তার ধর্মীয় কর্মসূচির মধ্যে প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে এরালির রচনা অনুসরণ করেছি। প্রকৃত সত্য কি তা ইতিহাসে উপলব্ধি করা অবশ্যই কঠিন, বিশেষত যখন বিতর্কিত চরিত্রের মূল্যায়ন করা হয়–এর একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় রিচার্ড। আমার মনে হয় এটিও মনে রাখা উচিত যে, যে কালে আওরঙ্গজেব রাজত্ব করেছিলেন–সেই ১৭ শতকের ইউরোপে খ্রিস্ট ধর্মের প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিক সম্প্রদায় পরস্পরের বিরুদ্ধে নৃশংস যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, যাতে ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসীদের নির্বিচারে হত্যা করা হত। ইংল্যান্ডে রাজা প্রথম চার্লসকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর ইংল্যান্ডের রক্ষক’ অলিভার ক্রমওয়েল কিছু ধর্মীয় উৎসব, থিয়েটার এবং মেপোল নৃত্যের মতো আরো অনেক বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেন। তার মূর্তিপূজা-বিরোধী অনুসারীরা ক্যাথলিক প্রতিমূর্তিগুলো বিকৃত করে দেয়। ক্যাথলিক প্রার্থনা অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করা হয় এবং কোনো ক্যাথলিক কোননা দফতরের পদাধিকারী হতে পারতো না।
অন্যান্য মোগলের মতো আওরঙ্গজেব মুসলিম চান্দ্র বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করেছেন, তবে আমি পশ্চিমা জগতের সাধারণ অব্দ অনুসরণ করেছি। আওরঙ্গজেবের শাসনকাল দীর্ঘসময় জুড়ে ছিল এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সময়ের মাপকাঠিকে ব্যবহারোপযোগী এবং সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। আর অবশ্য বর্ণনার সুবিধার উদ্দেশ্যে অনেক ঘটনা বাদ দেওয়া হয়েছে। ঐতিহাসিক টীকায় প্রকৃত তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে।