আহমদনগর থেকে ফেরার কিছুদিন পর একের পর এক ঘটনার খবর তার কানে আসতে থাকে–যা মোটেই অপ্রত্যাশিত ছিল না আর বেশির ভাগই ছিল দুঃখজনক। সম্রাটের ছেলেরা সাম্রাজ্য বিভক্ত করা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। শাহজাদা আজম আহমদনগরে রাজদরবারে ফিরে এসে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন। এর তিনমাসের মধ্যে শাহজাদা মুয়াজ্জম, আজমকে যুদ্ধে পরাজিত করে তাকে হত্যা করেন। আর সেই সাথে তিনিও বাহাদুর শাহ নাম নিয়ে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন। প্রায় একই সময়ে উদিপুরী মহল মারা যান– কথিত আছে আওরঙ্গজেবকে হারিয়ে তার শোকে তিনি মারা গিয়েছিলেন।
তার ছেলে কমবখস্ অবশ্য নিজেকে একজন শক্তিশালী এবং দৃঢ়চেতা মানুষ হিসেবে প্রমাণিত করেন, যা কেউ ভাবতে পারে নি। একজন কুশলী সেনাপতির মতো তিনি দুইবছর ধরে শাহজাদা মুয়াজ্জম আর তার সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করেন। যখন সম্ভইরা সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলেন, তখন সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে। মারাঠি আর শিখরা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে আর ‘ধূর্ত ফেরিওয়ালা’ হিসেবে যাদেরকে আওরঙ্গজেব একদিন বাতিল করেছিলেন, সেই ইংরেজরা সাম্রাজ্যের এই দুর্যোগের সময় যতটা পারে সুবিধা আদায় করে নিল। এখন থেকে ঠিক চার মাস আগে হায়দরাবাদের কাছে শাহজাদা মুয়াজ্জম অথবা সম্রাট বাহাদুর শাহ, যাকে এখন থেকে এ নামে ডাকতে হবে, শেষপর্যন্ত কমবখসূকে পরাজিত করলেন। যুদ্ধে গুরুতর আহত হয়ে পরদিন তিনি মারা যান। সিংহাসন কিংবা কফিন’-এর লড়াই, মোগল শাহজাদারা যেভাবে সিংহাসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন, যে কথা সম্রাট আওরঙ্গজেব বলতেন। কথাটি আবার সঠিক প্রমাণিত হল।
আর কয়েকমিনিটের মধ্যে নতুন সম্রাট আওরঙ্গজেবের একমাত্র জীবিত পুত্র-দরবার প্রাঙ্গণে এসে একটি মঞ্চের উপর থেকে প্রজাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। উমর আলি তার বাড়ির ছাদের উপর থেকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। হ্যাঁ ঐ যে বর্শার ডগায় সবুজ পতাকা পত পত করে উড়িয়ে সম্রাটের কুচকাওয়াজের প্রথম অশ্বারোহী দলটি মাঠে ঢুকছে। এর পেছনে ঘোড়ায় চড়ে আসছে নাকাড়া আর শিঙ্গাবাদক আর তারপর এক রাজকীয় বিশাল হাতির চারপাশ ঘিরে আরো অশ্বারোহী আসছে। হাতির পিঠে একটি রত্নখচিত খোলা হাওদা দেখা যাচ্ছে। হাতিটি দেখে বজ্রদেব মনে হচ্ছে, কিন্তু সে নিশ্চয়ই অনেক বুড়ো হয়ে গেছে? সুন্দর আলখাল্লা আর লম্বা পাখির লেজবিশিষ্ট পাগড়ি পরে মুয়াজ্জম হাওদায় বসে রয়েছেন। তার পেছনে যে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সে নিশ্চয়ই তার প্রধান দেহরক্ষী। এই জায়গায়টি ছিল উমর আলির, যখন সে প্রায়ই আওরঙ্গজেবের সাথে হাতির পিঠে চড়তো।
একটু পরই শিঙ্গা ফুঁকতেই বাহাদুর শাহ একটু আড়ষ্ট হয়ে হাতির পিঠ থেকে নামলেন। পঁয়ষট্টি বছর বয়সী সম্রাট উমর আলির চেয়ে মাত্র কয়েক বছরের ছোট। এখন তিনি মঞ্চের দিকে যাচ্ছেন। ভাষণে তিনি কী বলবেন? তার শাসনে সাম্রাজ্য কী আবার সমৃদ্ধি লাভ করবে? তবে তার নাতনি রেহানা আর তার ছোট্ট খেলার সাথী রবির কাছে এসবের মূল্য কী?
.
ঐতিহাসিক টীকা
এম্পায়ার অফ দি মোগল সিরিজের আগের পাঁচটি পুস্তকের মতো এটি একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। অর্থাৎ, কাহিনীটি ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে রচিত হলেও এর চরিত্রগুলোর কথোপকথন, চিন্তাচেতনা এবং প্রত্যক্ষ কার্যকলাপ কল্পনাপ্রসূত। যখন আমি একটি চরিত্রের মুখে কোনো শব্দ বসাই, তখন তা এমনভাবে সাজাই যেন, চরিত্রটি সে সময়ে কি ভাবতে অথবা কি বলতে পারতো, তা এতে প্রতিফলিত হয়। অনেক সময় কথাগুলো আমার কল্পনার সম্পূর্ণ বিপরীত হতো, অর্থাৎ আমি যে ইউটোপিয়ান কিংবা স্বর্গরাজ্যের কল্পনা করতাম, যেখানে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষ পাশাপাশি শান্তিতে বসবাস করবে এবং একে অপরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সম্মান করবে, তার বিপরীত। বিশেষত আওরঙ্গজেবের মতো একজন বিতর্কিত চরিত্রের ব্যাপারে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা, যথেষ্ট আবেগের বহিপ্রকাশ ঘটাবে।
আওরঙ্গজেবের জীবন সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্যের উৎস রয়েছে। তার পূর্বপুরুষদের মতো তিনিও তার শাসনামলের প্রতিদিনকার ঘটনাপঞ্জি লিপিবদ্ধ করিয়েছিলেন। এর নাম আলমগীর-নামা আর এটি রচনা করেছিলেন মোহাম্মদ কাজিম। তবে দশ বছর শাসন করার পর আওরঙ্গজেব তাকে এটি রচনা করতে নিষেধ করলেন। কেননা তিনি মনে করতেন ঘটনাপঞ্জি রচনা এক ধরনের দাম্ভিকতা। সমসাময়িক অন্যান্য ঘটনাপঞ্জির মধ্যে ছিল : মুফাজ্জল খান রচিত তারিখ-ই-মুফাজ্জলি, এটা রচিত হয়েছিল পৃথিবীর সূচনা থেকে আওরঙ্গজেবের শাসনের দশ বছর পর্যন্ত; রাই ভর মলের লুব আল-তাওয়ারিখ-ই-হিন্দ, আরেকটি ছিল দারা শিকোর একজন সভাসদ রচিত হিন্দুস্তানের সকল শাসকের ইতিহাস। মিরাত-ই-আলম রচনা করেছিলেন বখতিয়ার খান নামে আওরঙ্গজেবের অধীনে চাকরিরত একজন খোঁজা; তবে অনেকে মনে করেন এর রচয়িতা হচ্ছেন তার বন্ধু মোহাম্মদ বাকা। ঈশ্বরদাস নগর নামে আওরঙ্গজেবের একজন সভাসদ রচনা করেছিলেন, ফুতুহাত-ই- আলমগিরি। মুনতাখাব আল-লুবাব নামে তৈমুর আর তার বংশধরদের একটি ইতিহাস গোপনে রচনা করেছিলেন কাফি খান নামে আওরঙ্গজেবের একজন সভাসদ। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর কিছুকাল পর তিনি এটি সম্পূর্ণ করেন। সিংহাসনে আরোহণের পর মুয়াজ্জমের নির্দেশে আওরঙ্গজেবের দরবারের একজন লিপিকার মাসিরি-ই-আলমগিরি রচনা করেন। এছাড়া কোনো এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি আখাম-ই-আলমগিরি নামে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে কিছু কাল্পনিক কাহিনি রচনা করে।