উদিপুরী মহলের সাথে আলোচনার পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি সেই সন্ধ্যায় চিঠিগুলো লিখলেন। তারপর চিঠিগুলো একবার পড়লেন, তিন ছেলেকে আলাদা আলাদা করে লেখা চিঠি। প্রতিটি চিঠিতে তিনি তাদেরকে জোর দিয়ে বলেছেন যে, সাম্রাজ্য বিভক্ত করার তিনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা যেন ওরা মেনে নেয়। আর তারা যেন ভালোভাবে এবং বিশ্বস্ততার সাথে শাসন করে এবং নিশ্চিত করে যেন, তাদের প্রজারা তাদের মতো ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলে। চাপা স্বভাবের মুয়াজ্জমকে আর কিছু বললেন না, তবে অন্য দুজনকে লিখার সময় তার ইচ্ছে হল মন খুলে তাদেরকে কিছু বলতে, যা এর আগে জীবনে কখনও করেন নি। আর ওরা সামনে থাকলে তো কখনও না। তার মন থেকে ভয় আর অনুতাপ হুড়মুড় করে বের হয়ে যেতেই তিনি এক ধরনের মুক্তি অনুভব করলেন। তিনি আজমকে সতর্ক করে বললেন, রাষ্ট্রনায়োকচিত আচরণ করতে আর কিছু করার আগে একটু ভেবে নিতে। বিশেষত শত্রুর মন বুঝার চেষ্টা করতে হবে–তার মনে পড়লো কথাটি তিনি অনেক বছর আগে আজমের ভাই আকবরকে বলেছিলেন। তিনি লিখলেন :
*
আমি একা এসেছি আর একজন আগন্তুকের মতো চলে যাচ্ছি। যে মুহূর্তে ক্ষমতা পেয়েছি তখন থেকে দুঃখই পেয়েছি। যে জীবন এত মূল্যবান তা আমি অপব্যয় করেছি। জীবন ক্ষণস্থায়ী। অতীত চলে গেছে আর ভবিষত্যের কোনো আশা নেই। আমি ভয় পাচ্ছি আমার পাপ মোচন হবে কি-না। আমি শাস্তির ভয় পাচ্ছি। আমি আল্লাহর রহমত আর করুণায় বিশ্বাস করি তবে আমার ভয় হয় আমি যা করেছি তার জন্য।
*
কমবখসকে লিখতে অনেক বেশি সময় লেগেছিল। কাশির কারণে মাঝে মাঝে থামতে হয়েছে, আবার শক্তি সঞ্চয় করার জন্যও থামতে হয়েছে।
*
সবসময় নিজের মনোভাব গোপন রাখবে। ভালো উপদেষ্টা বেছে নেবে, যে তোমার সক্ষমতায়, যেখানে তুমি দুর্বল সেখানে ঘাটতি পূরণ করবে। তবে তাদেরকে পুরোপুরি বিশাস করো না। মনে রেখ বিশ্বাসঘাতক সবসময় ছায়ার মধ্যে রয়েছে। কখনও নিজের ছেলেদের বিশ্বাস করো না, কিংবা খুব বেশি ঘনিষ্ঠ হইও না। কেননা আমার বাবা যদি দারা শিকোকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় না দিতেন, তবে তার সমস্ত বিষয় এরকম ভেস্তে যেত না। আমার জানের জান, আমি একা চলে যাচ্ছি। তোমার অসহায়তার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে। আমি যত পাপ করেছি, যত ভুল করেছি, তার পরিণতি নিজে বহন করছি। আমি এই পৃথিবীতে কিছুই নিয়ে আসি নি। আর এখন পাপের এই প্রকাণ্ড কাফেলা নিয়ে যাচ্ছি। যেদিকে তাকাই কেবল সেদিকে আল্লাহকে দেখছি। আমি ভয়ঙ্কর পাপ করেছি, জানি না কি শাস্তি আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
সবশেষে আমি তোমার মা উদিপুরী মহলকে তোমার হাওলায় তুলে দিয়ে যাচ্ছি। আমার জীবনের শেষ বছরগুলোতে তিনি আমার জন্য এক বিশাল সান্ত্বনা হয়েছিলেন। তাঁকে ভালোবেসে খুব ভালোভাবে তাঁর যত্ন নিও।
*
বেহারারা আওরঙ্গজেবকে পালকিতে করে মসজিদ থেকে তাঁকে তার ঘরের দিকে ফিরে নিয়ে চললো। শুষ্ক বাগান থেকে জোর হাওয়ায় ধুলার ছোট ছোট পেঁচালো আকৃতি উপরের দিকে উড়িয়ে নিল। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়তে পেরে তিনি খুব খুশি হলেন। সবসময় যেরকম হতো আজও সেরকম শান্তি আর নৈতিক অনুপ্রেরণা পেলেন। ঘরের দুই-তিন গজ আগে থাকতেই তিনি বেহারাদের বললেন, ‘থাম! বাকি কয়েক পা আমি হেঁটেই যাব।’
দুজন কোরচি তাঁকে দাঁড়াতে সাহায্য করে তার হাতে দুটো বেতের লাঠি দিল। ধীরে ধীরে তবে দৃঢ়তার সাথে হেঁটে তিনি ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। প্রখর সূর্যের আলো থেকে কামরার আধো অন্ধকার আলোয় তার দুর্বল চোখ সয়ে নিতে এক মুহূর্ত থামলেন, তারপর হাতের ইশরায় দুই কোরচি আর অন্যান্য পরিচারককে বিদায় করলেন। তোমরা যাও। আমি এখন বিশ্রাম নেব।’
ওরা চলে যাওয়ার পর তিনি বিছানার দিকে এগিয়ে গেলেন। বিছানার কাছে পৌঁছতেই অনুভব করলেন বুকে চাপ চাপ লাগছে আর নিশ্বাস নিতে গিয়ে হাঁপাতে শুরু করলেন। বুঝলেন, তিনি মরতে চলেছেন…লাঠিগুলো ফেলে হাঁটুগেড়ে বিছানার পাশে বসে পড়লেন। সবসময় তার কোমরে গুঁজে রাখা জেড পাথরের তসবিহটা আঁকড়ে ধরলেন। তিনি এক শুক্রবারেই মারা যাচ্ছেন, যা সব সময় কামনা আর প্রার্থনা করতেন…শীঘ্রই তিনি জানতে পারবেন তার জীবন সম্পর্কে আল্লাহ তার জন্য কি রায় দিয়েছেন। বেশ কিছুসময় তিনি তাঁর শুকনো ঠোঁটে দোয়া পড়তে থাকলেন আর সেই সাথে লম্বা প্রায় হাড়সর্বস্ব আঙুল দিয়ে তসবিহ গুণে চললেন। একটু পরই তসবিহ থেমে গেল…যষ্ঠ মোগল সম্রাটের মৃত্যু হল।
.
উপসংহার
দিল্লির দরবার প্রাঙ্গণের সামনে একটি সুন্দর বাড়ির সমতল ছাদে উমর আলি বসে রয়েছে। একটি বড় ছাতা তাকে মধ্য সেপ্টেম্বরের রোদ থেকে ছায়া দিচ্ছে। আড়াই বছর আগে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর সাথে সাথে তার রাজকীয় দেহরক্ষীদলের প্রধানের পদটিরও অবসান হয়েছিল। সাথে সাথে উমর আলি দিল্লি ফিরে এসে এই বাড়িটিতে তার একমাত্র মেয়ে আর মেয়ের জামাই এবং তাদের একমাত্র কন্যাসন্তান রেহানাকে নিয়ে থাকতে শুরু করে। উমর আলির স্ত্রী অনেক দিন হল মারা গেছে। তার মেয়ের জামাই একজন হেকিম। ছোট্ট রেহানা এখন তার হিন্দু প্রতিবেশীর পাঁচবছরের ছেলে রবির সাথে খেলা করছে।