তবে সেই মুহূর্তটি কখন আসবে? তিনি সুযোগের অপেক্ষা করছিলেন। অপেক্ষা করছিলেন দেখতে যে, রোজকার খাবার বিতরণের কাজটি গতানুগতিক হতে হতে একসময় প্রহরীরা পুরোপুরি কখন এ থেকে সম্পূর্ণ আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তার মনে একটু অহঙ্কার ছিল যে, ধৈর্য ধরা আর সেই সাথে ঠিক কখন আঘাত হানতে হবে সেটি জানাটাও তার একটি শক্তি। একুজি বাজারে জোর গুজব শুনে এসেছে যে, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আওরঙ্গজেব কান্দাহার অভিযানে সেনাবাহিনী পাঠাবেন আর সেই সাথে তার মারাঠি বন্দীদেরকেও তাদের সমস্যাসঙ্কুল নিজের দেশ থেকে কাবুলে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেবেন। একথাটি যদি সত্যি হয় তবে মাহেন্দ্রক্ষণটি এগিয়ে আসছে।
ঝুড়িগুলো পাঠিয়ে দেবার পর একুজি একটি পিতলের ঘটিতে তার প্রভুর পানের জন্য পানি ঢেলে একজন ভৃত্যকে পান করতে দিল। খাবারের স্বাদ গ্রহণের জন্য শিবাজি কয়েকজন ভৃত্য রাখার অনুমতি পেয়েছিলেন। এই অনুষ্ঠানটি লক্ষ করে শিবাজি মুখ বাঁকিয়ে হাসলেন। কারাগারে বন্দী হওয়ার পর প্রথম প্রথম তিনি সন্দেহ করতেন যে, আওরঙ্গজেব হয়তো তাকে বিষপ্রয়োগ করতে চেষ্টা করবেন কিংবা তার গলায় ছুরি চালাবার জন্য একজন গুপ্তঘাতক পঠাবেন। কিন্তু কিছুই হয় নি। এ ধরনের কাঁচা কাজ করে একজন শহীদ সৃষ্টি না করে আওরঙ্গজেব বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। শিবাজি এখন বুঝতে পেরেছেন দুর্গে থাকাকালীন হয়তো তিনি যথেষ্ট নিরাপদ থাকবেন। তার জীবন নাশের যেকোনো চেষ্টা সম্ভবত আগ্রা থেকে কান্দাহারের পথে হতে পারে। লোকজনের চোখ-কান এড়িয়ে অনেক দূরে এমনভাবে কাজটি করা হবে যেন, কোনো ডাকাত কিংবা বিদ্রোহীর ঘাড়ে দোষ চাপানা যায়। সম্রাটের দিকে কেউ আঙুল দেখাতে না পারে। এই আরেকটি কারণে আওরঙ্গজেব তাকে কান্দাহার পাঠাবার আগেই তাকে অবশ্যই পালাতে হবে।
এখন মনে হচ্ছে যেন, দেবতারা তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছেন। ঘণ্টাখানেক আগে একুজি যখন বাজারে ছিল তখন তিনি প্রহরীদেরকে কিছু বলাবলি করতে শুনেছিলেন, যা যতশীঘ্র সম্ভব তার নায়েবকে জানাতে হবে। পানির পাত্রটি একুজির হাত থেকে নেবার সময় তিনি তার গলায় ঝুলানো একটা চামড়ার ফিতা থেকে ঝুলে থাকা পিতলের গনেশের মূর্তিটি ছুলেন। গোপন সঙ্কেতটি টের পেয়ে একুজি বুঝতে পারলো যে, তিনি প্রহরীদের কান এড়িয়ে তাকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা বলতে চাচ্ছেন। কালো পাগড়িপরা মাথাটা সামান্য হেলে সে সায় দিল।
পানি খাওয়া শেষ করে শিবাজি ধীরে ধীরে উঠান পেরিয়ে উঁচু একটা দেয়ালের পেছনে লুকানো ছোট প্রস্রাবখানার দিকে এগোলেন। একুজিও দ্রুত সেখানে গেল। দুজনেই কানখাড়া করে একমুহূর্ত অপেক্ষা করলেন, তবে উঠান থেকে কোনো শব্দ শোনা গেল না। শিবাজি সশব্দে প্রস্রাব করতে শুরু করে ফিসফিস করে তার নায়েবকে বললেন, তুমি যখন বাইরে ছিলে তখন আমি শুনলাম একজন প্রহরী বলছিল, পানিপথ যুদ্ধে মোগলদের বিজয়ের বার্ষিকী পালনের জন্য আগামীকাল বিরাট ভোজ আর আতশবাজির উৎসব হবে। সেদিন থেকেই তাদের হিন্দুস্তানের অভিশপ্ত বিজয়যাত্রা শুরু হয়েছিল।
‘হা মহারাজ। আমিও বাজারে লোকজনদের এটা বলাবলি করতে শুনেছি। আর ফেরার পথে দেখলাম বড় একটি মাঠে সবুজ মখমলের তাঁবু খাটানো হচ্ছে। মনে হয় সেখানেই ভোজ হবে।’
‘চমৎকার। পুরো দুর্গে সবার মনোযোগ ভিন্নমুখী থাকবে। পালাবার চেষ্টা করার জন্য এটাই সুবর্ণ সুযোগ। শিবাজি শরীর বাঁকা করে চওড়া গলার একটি মাটির ঘড়া থেকে পানি ঢেলে নিয়ে হাত ধুলেন। আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। কিভাবে পালাতে হবে সেটা ওরা কয়েকশো বার আলোচনা করেছেন মাঝে মাঝে এই প্রস্রাবখানায়, আবার অনেকসময় গভীর রাতে ফিসফিস করে পুরো পরিকল্পনার প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন।
রাতে বিছানায় শুয়ে শিবাজি ফিসফিস করে তার পাশে শোয়া ছেলেকে খবরটা জানালেন। এই প্রথম তিনি তার নয় বছর বয়সি ছেলে সম্ভাজিকে এই পরিকল্পনার কথা জানালেন আর অনুভব করলেন কথাটা শুনেই তার ছেলের দেহ শক্ত হয়ে গেল। তিনি তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, কোনো চিন্তা করোনা, শুধু আমি আর একুজি তোমাকে যা যা করতে বলবো ঠিক তাই করবে, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
পরদিনটি এত ধীরে কাটছিল যে, শিবাজি প্রায় অস্থির হয়ে উঠলেন। তবে বিকেল গড়াতেই তার চার দেয়াল ঘেরা আবাসের বাইরে থেকে মানুষের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, সম্ভবত ভোজের অতিথিরা এসে গেছে। সূর্য দিগন্তে ডুবে যাওয়ার আগেই প্রচণ্ড শব্দে প্রথম আতশবাজি আকাশে উড়লো। ছোট ছোট তারাগুলো ভালভাবে দেখা যাচ্ছে না। তারপর পরই উল্লসিত চিৎকার। একুজি রোজকার মতো ঠিক সময়েই বাজারে গিয়েছে। তিনি আশা করলেন উৎসব চলাকালীন বাজার হয়তো ভোলা থাকবে, যাতে একুজি শুকনো খাবাগুলো কিনতে পারে আর গাধার গাড়িটি দুর্গে ঢুকে বেতের ঝুড়িগুলো নিতে পারবে। নায়েবের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করার সময় তিনি ধীর স্থির থাকার চেষ্টা করলেন, অহেতুক উঠানে পায়চারি কিংবা অস্বাভাবিক কিছু করা থেকে বিরত থাকলেন যাতে দুই প্রহরীর দৃষ্টি আকৃষ্ট না হয়। প্রহরী দুজন একটা নিম গাছের ছায়ায় বসে পান চিবুচ্ছিল। শেষপর্যন্ত একুজি ফটকে এসে হাজির হল আর তার পেছনে দুজন কুলির মাথায় দুটো ঝুড়ি যথারীতি দেখা যাচ্ছে। এবার তার শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল। এপর্যন্ত ঠিক আছে, তবে কঠিন কাজটি এখনও বাকি রয়ে গেছে।