একমাত্র যে সমাধানটি তার মনে জেগেছিল সেকথাটি ভাবলে মনে হয় এই পরিকল্পনাটি হয়তো তার যৌবনে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো। তিনি ঘোষণা করবেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর পুরো সাম্রাজ্য তাঁর ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে। এতে হয়তো রক্তপাত বন্ধ হবে আর সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশের মাঝে দৃঢ়ভাবে শাসন নিশ্চিত করার সুবিধা পাওয়া যাবে। তিনি যেভাবে সাম্রাজ্যের পরিধি বাড়িয়েছিলেন, তাতে পুরো সাম্রাজ্য শাসন করা তার যে কোনো একজন ছেলের ক্ষমতার বাইরে। তিনি নিজে তার সমস্ত কুশলতা দিয়ে এটি অর্জন করেছিলেন। তবে তার মনে ভয় হচ্ছে, তারপরও তার ছেলেরা একটি অবিভক্ত সিংহাসনের জন্য লড়াই করবে।
যাই হোক, কমবখস চলে যাওয়ার পর তিনি ছেলেদেরকে চিঠি লিখে উত্তরাধিকারত্ব তিনভাগে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন। তারপর খবরটি তাদেরকে হজম করার সময় দিয়ে রাজদরবারে আর প্রজাদের সামনে ঘোষণা করবেন।
*
আওরঙ্গজেব উদিপুরী মহলকে বললেন, ‘আহমদনগরে এসে থেমেছি প্রায় একবছর হল। আমি এখন এই সত্যিটা স্বীকার করছি যে, এখানেই আমার মৃত্যু হবে।’ উদিপুরী মহল তার কপাল থেকে ঘাম মুছে দিচ্ছিলেন। জ্বরের প্রকোপটা এখন একটু কমে এসেছে, তবে আহমদনগরে আসার পর আরো কয়েকবার জ্বর কমে আবার বেড়েছিল আর মনে হয় এবারও শেষও নয়। সারা বছরই তার স্বাস্থ্যের অবস্থা উঠানামা করেছে। এখন প্রচণ্ড গরমের পর মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি হয়ে আবহাওয়াও ঠাণ্ডা হচ্ছে, কিন্তু তিনি জানেন তিনি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়েছেন আর ঘন ঘন জ্বর হচ্ছে। আর ঘন ঘন কাশিটা থামছেই না। ইসলামিক টুপি সেলাই করা আর পবিত্র কিতাব হাতে লিখে নকল করার কাজে তিনি তার সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করেছিলেন।
উদিপুরী উত্তর দিলেন, আপনার কথা হয়তো ঠিক। তবে এখানে আপনি আরাম পাচ্ছেন। কাসিদরা দ্রুত পুরো সাম্রাজ্যের খবর এনে দিচ্ছে। খামাকা কেন কষ্টকর সফরের কথা ভেবে মনে কষ্ট পাচ্ছেন?
কারণ আমি অনুভব করছি আমার কিছু অসমাপ্ত পারিবারিক কাজ রয়ে গেছে। একটি বিরাট অপরাধের বোঝা কখনও প্রশমিত করতে পারবো না। বরং এই ভারী বোঝা নিয়ে আর দোষী সাব্যস্ত হয়ে আমি এখানেই মরবো। তারপর তিনি মাথা এপাশ ওপাশ করতে লাগলেন আর সাথে সাথে আবার ঘামতে শুরু করলেন। কয়েকমিনিট পর আবার বললেন, যখনই আমি একটু ভাল বোধ করি তখন আমি ইতোপূর্বেকার পাঁচজন সম্রাটের ইতিহাস পড়ি। ওরা সবাই তাঁদের পরিবারের সাথে লড়াই করেছেন, শেষ তিনজন তাদের ছেলেদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। আমার বাবাসহ শেষ দুইজনও পরিবারের সাথে লড়াই করেছেন। আর আমার রাজত্বে দুই ছেলে আমার সাথে লড়াই করেছে। আমাদের রাজবংশ বিদেশি শত্রুদের পরাজিত করেছে আর সাম্রাজ্যের সীমানা বাড়িয়েছে কিন্তু কখনও নিজেদের মাঝে শান্তি আসেনি। কেন আমরা আর ..কেন আমি কখনও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেই নি? আমি বিশ্বাস করেছিলাম, ধর্মীয় সততা না থাকাটাই দোষী হওয়ার জন্য যথেষ্ট আর চেষ্টা করেছি আমার সন্তানদেরকে কঠোর ধর্মীয় বিশ্বাসের সীমার মাঝে আবদ্ধ রাখতে আর চেয়েছিলাম বাবা হিসেবে ওরা আমাকে মান্য করুক যা আমাদের ধর্মমতে বলা হয়েছে, কিন্তু কোনো ফল হল না। এখন মৃত্যু যখন কাছে এগিয়ে এসেছে, তখন আমি আমার ছেলেদেরকে একসাথে আমার পাশে আনতে পারছি না, এই ভয়ে যে ওরা আমার সিংহাসন নিয়ে লড়াই করবে। আর যদি আসেও, সেটা আমাকে ভালোবাসে বলে নয়, আসবে আমার সিংহাসনের লোভে।
‘এটা কমবখসের বেলায় সত্যি নয়।’
‘আমি শুধু আশা করতে পারি যেন, একথাটা সত্যি হয়। তবে সে অন্য দুজনের মতোই তার প্রদেশের সবচেয়ে কাছের সীমান্তে অপেক্ষা করছে, যেন খবর পাওয়ার এক মুহূর্তের মধ্যে রওয়ানা দেবার জন্য তৈরি থাকে।
‘উত্তরাধিকারত্ব তিনজনের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ায় সে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ, এ ব্যাপারে আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি–সে কেবল তার ভাইদের উদ্দেশ্যকে ভয় পায়।
‘এধরনের ভীতির ভান করা অনেক সময় উচ্চাকাঙ্ক্ষার খোলস প্রমাণিত হয়েছে। তবে আমার বংশ রক্ষা করার জন্য আমি আর কী করতে পারি? প্রতিদিন আমার শক্তি কমে যাচ্ছে আর বৃদ্ধ বয়সের ক্লান্তি আমার মন আর দেহকে আরো অবসাদ এনে দিচ্ছে। স্মরণশক্তি মাঝে মাঝে এমনভাবে কমে যায় যে, গতকাল কি হয়েছে তা মনে করতে কষ্ট হচ্ছে। আর যৌবনের ঘটনাগুলো আরো পরিষ্কার মনে পড়ে। তুমি আমার এত যত্ন নেওয়া সত্ত্বেও আমি একাকীত্ব অনুভব করি…অপরাধ বোধের বোঝা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে একা হয়ে যাই।’ আবার আওরঙ্গজেব মাথা এপাশ-ওপাশ করতে লাগলেন।
‘শান্ত হোন, জান। আপনার স্মৃতি হয়তো সামান্য কমেছে, তবে এটা অধিকাংশ মানুষের মতো এখনও তীক্ষ্ণ আছে। অন্তত ছেলেদেরকে উপদেশ দিয়েও তো আপনি চিঠি লিখতে পারেন, তাই না? ওদের সামনে যে বিপদ আপনি দেখতে পাচ্ছেন, তা এড়াতে আপনার অভিজ্ঞতা থেকে ওদেরকে আপনি সাহায্য করতে পারেন। সর্বোচ্চ ক্ষমতার পুরস্কারের সাথে সাথে কি বোঝা আর দায়িত্ব কর্তব্য চলে আসে সে ব্যপারে ওদেরকে পথ দেখান।
আওরঙ্গজেব একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘তা পারি…তবে ওরা এতে কতটুকু মনোযোগ দেবে? আর ওদের জায়গায় হলে আমিই বা ততে কি মনোযোগ দিতাম?’