সকলে তার সিংহাসনের সামনে সমবেত হওয়ার পর তিনি শুরু করলেন, ‘আজকের এই সভায় সকলকে আমি ডেকেছি, কারণ আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেব। আমাকে শারীরিক অসুস্থততায় আমাকে দেখার জন্য আমার ছেলে আজম এসে আমার প্রতি যে উদ্বেগ দেখিয়েছে, সে জন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ।
তার ঠিক বামপাশে সামনে দাঁড়ান আজম মৃদু হাসলেন।
‘আমি যতদূর শুনেছি গুজরাটের সুবেদার হিসেবে সে চমৎকার কাজ দেখিয়েছে, একারণে সে এবং তার অনুগত কর্মকর্তাদের সত্যি গর্বিত হওয়া উচিত। তাদের কর্মকাণ্ড এত চমৎকার হয়েছে যে, আমি আজমকে অন্য এক পদে বদলি করতে চাচ্ছি আর তার বিশ্বস্ত কর্মকর্তারা গুজরাটে থেকেই তাদের কাজ চালিয়ে যাবে।’
‘অন্য পদে বাবা? কি পদে?
‘মালওয়ার সুবেদারি। এটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রদেশ আর সেখানে রাজস্ব বাড়ানো, দুর্নীতিরোধ আর ডাকাত দমনের জন্য অনেক কিছু করার আছে।’
কিন্তু বাবা। আমি তো গুজরাট ফিরে যেতেই পছন্দ করবো…’
‘এখানে আসার পর প্রথমে তুমি আমাকে বলেছিলে আমার অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করার জন্য তুমি সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করবে আমার মনে হয় তাই বলেছিলে তুমি–এখন সেটা কর।’
‘মালওয়ার যদি যেতেই হয়, তবে আমার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন কর্মকর্তাকে সাথে নিতে চাই।’
আওরঙ্গজেব ঘুরে আজমের দিকে তাকলেন। আর তার ছেলে তার বাবার চোখে সেই পুরোনো আগুন দেখতে পেলেন। তিনি বললেন, আমি যতদিন শাসন করছি, ওরা আমার অধীনস্ত কর্মকর্তা, তোমার নয়। আর ওরা কোথায় যাবে না যাবে সে সিদ্ধান্ত আমি নেব তুমি নয়। আমি তোমাকে বলেছি গুজরাটে যে ভালো কাজ হয়েছে তা চালিয়ে যেতে ওরা ওখানেই থাকবে। এখন যাও কয়েকদিনের মধ্যে তোমার নতুন প্রদেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নাও।’ এমন সময় প্রচণ্ড কাশির দমকে সম্রাটের কথা একটু থেমে গেল, তারপর কাশি সামলে তিনি আবার বললেন, আমার কথামতো নতুন জায়গায় দায়িত্ব নেবার জন্য চলে গিয়ে তুমি প্রমাণ করবে যে সব সময়ের মতো তুমি আমার প্রতি বিশ্বস্ত আর অনুগত।
আজম মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করলেন, কোনো কথা বললেন না। তবে তার মুখের ভাব দেখে আওরঙ্গজেব বুঝতে পারলেন তিনি যে বার্তা তার ছেলেকে দিয়েছেন, তা তিনি বুঝতে পেরেছেন।
নিজের কামরায় ফেরার পর আওরঙ্গজেব উদিপুরী মহলের বাহুতে প্রায় ঢলে পড়লেন। তিনি তাকে ধরে বিছানায় নিয়ে গেলেন। আওরঙ্গজেব মন্তব্য করলেন, ‘আল্লাহর শুকরিয়া যে, আমি তাদের দেখিয়েছি, বুড়ো বাঘ এখনও গর্জন করতে পারে।
*
এক সপ্তাহ আগে রাজদরবারের সভায় আওরঙ্গজেব যে শক্তি দেখিয়েছিলেন, তারপর মাত্র ধীরে ধীরে সেই ধকল কাটিয়ে উঠছিলেন। উদিপুরী মহল তাকে জিজ্ঞেস করলেন, যদিও আজম চলে গেছে–তারপরও আমি আমাদের ছেলের জন্য দুশ্চিন্তায় আছি। আপনি কি কমবখস্ত্রে জন্য আর কিছু করতে পারেন না?”
আওরঙ্গজেব একটু উত্তেজিত কণ্ঠে উত্তর দিলেন, আমি আজমের উচ্চাকাঙ্ক্ষা দমিয়ে দিয়েছি আর মুয়াজ্জমকে কঠোর ভাষায় লিখে বলেছি তার সেনাসামন্ত নিয়ে দাক্ষিণাত্যে থাকতে? আর কী চাও তুমি? একটু থেমে তারপর আবার বললেন, কমবখস্ নিজেকে আমার সামনে তুলে ধরার জন্য তোমার সাহায্য নিয়ে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করছে। যখন আমি থাকবো না তখন তার নিজেকে আরো শক্তিশালী দেখাতে হবে।’
‘সে এর কিছুই জানে না, আমি হলফ করে বলছি। তাকে বেশি ক্ষমতা দেওয়ার জন্য নয় আপনাকে আমি অনুরোধ করছি না, আমি শুধু চাই তাকে আপনি তার ভাইদের কাছ থেকে দূর কোনো প্রদেশে আপনার বিশ্বস্ত কিছু কর্মকর্তা সাথে দিয়ে পাঠান, যাতে ওরা তাকে নিরাপত্তা দিতে পারে। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজদরবার আর এর চারপাশে যে ষড়যন্ত্র ঘুরপাক খাচ্ছে, তা থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রাখা। আর আপনার যখন মৃত্যু হবে প্রার্থনা করি তা যেন অনেক দেরিতে হয়, তখন এই ষড়যন্ত্র দ্বিগুণ হবে। আপনাদের দুজনের মৃত্যু আমার সহ্য হবে না। আমি চাই সে যেন এখনি নিরাপদ কোনো জায়গায় চলে যায়। কথা শেষ করেই উদিপুরী মহল যুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন।
তিনি যদি সত্যিই তার ছেলেকে দূর কোনো প্রদেশে পাঠাতে চান, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই উচ্চাকাঙ্ক্ষার বদলে তার জীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন। তার বড় সৎ ভাইদের তুলনায় কমবখসের খুব একটা সমর্থক ছিল না। সম্ভবত এটা তার মায়ের সাধারণ বংশ ধারার কারণে আবার সেই সাথে ভাইদের তুলনায় তার বয়সও কম। যদিও এখন তার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। এছাড়া তার যুদ্ধাভিযানের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল না। সে প্রায়ই উদিপুরী মহলের ইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার করে রাজদরবারেই থাকতে রাজি হত।
“ঠিক আছে। আমি তার জন্য একটা প্রদেশ খুঁজে বের করবো আর সাথে বিশ্বস্ত লোক দিয়ে তাকে সেখানে পাঠাব।’
আওরঙ্গজেব যে কথাটি প্রকাশ করেন নি, তা হল উত্তরাধিকারের বিষয়টি নিয়ে তিনি বেশ কয়েক মাস যাবত দুশ্চিন্তায় আছেন। বাবা আর ভাইদের সাথে তার আচরণের কারণে, যে সন্দেহ আর অপরাধবোধ দিন-রাত তার মনকে আচ্ছন্ন। করে রেখেছিল, সেই ভার মন থেকে নামাতে পারছিলেন না। আর সেই সাথে উদ্বিগ্ন ছিলেন সিংহাসনের জন্য তার ছেলেদের পরস্পরের মাঝে সংঘর্ষ কিভাবে এড়ান যায়, যা তিনি নিজেও তার ভাইদের সাথে করেছিলেন। …কিভাবে আবার সেই ‘সিংহাসন কিংবা কফিন’–এই প্রবাদটি এড়ানো যায়। তিনি দীর্ঘদিন গভীরভাবে চিন্তা করে দুনিয়ার সামনে একজন উত্তরাধিকার ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ছেলেদের উপর তার তেমন আস্থা ছিল না, যে কে এতে সফল হবে। তিনি সবসময় ছেলেদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন, কাউকে বিশেষ প্রিয় হিসেবে মনে করেন নি। মুয়াজ্জম আর কম বখস্, উভয়কেই কারাদণ্ড দিয়েছিলেন–একজনকে রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা অপরজনকে নৈতিক স্থলনের কারণে। ওরা তিনজনই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে তাঁকে হতাশ করেছে। এছাড়া শাহজাহান দারা শিকোকে তার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার মনোনীত করলেও ওদের কাউকেই তাদের নিজ উচ্চাকাঙ্ক্ষা রোধ করতে পারে নি।