অবশ্য কমবখস্ আর উদিপুরী মহল কেবল কমবখসের প্রতি তার আগ্রহ বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন, ওরা সিংহাসন জবরদখল করার চেষ্টা করছিলেন না। তবে আজমের বিষয়ে তিনি একই কথা বলতে পারছেন না। তার স্ত্রী জানির মৃত্যুর পর তিনি আবার তার পুরোনো স্বভাবে ফিরে গেছেন। একবার তিনি আর তার অশ্বারোহীসেনারা গুজরাটি বিদ্রোহীদের তাড়া করতে গিয়ে বিদ্রোহীদের অতর্কিত হামলার মুখে পড়ে যান। কেবল তার ব্যক্তিগত সাহসিকতার কারণে সেবার প্রাণে বেঁচে যান। তারপরও বিনাকারণে তিনি তার ভালো কয়েকজন সেনা হারিয়েছেন। আবার এদিকে মুয়াজ্জম গোয়ালিয়র থেকে মুক্তি পাবার পর বাবার সামনে এলে একেবারে মৌনি হয়ে থাকেন। তার মনোভাব বুঝা কঠিন। মুয়াজ্জম প্রকাশ্যভাবে এমন কোনো কাজ করবেন না যাতে সামান্যতম ভুল হওয়ার আশঙ্কা আছে আর তার বাবা তাকে আবার কারাগারে বন্দী করেন কিংবা এমনকি প্রাণদণ্ড দেবারও আশঙ্কা আছে।
যাই হোক সবার আগে আজমকেই সামলাতে হবে। আর যদি তার ভুল না হয়ে থাকে এখন উত্তর-পশ্চিম দিগন্তে যে ধুলার মেঘ দেখা যাচ্ছে, তা নিশ্চয়ই তার পুত্রের আগমনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাদের সাক্ষাৎকারের জন্য তাঁর যে সামান্য মানসিক আর শারীরিক শক্তি এখনও অবশিষ্ট আছে তা তুলে ধরতে হবে।
দুই ঘণ্টা পর আওরঙ্গজেব রাজদরবারের উপযোগী পোশাক আর তৈমুরের বাঘের আংটিটি আঙুলে পরে আহমেদনগর দুর্গের একটি রাজকীয় কামরায় একটি সোনালি গিল্টি করা সিংহাসনে বসলেন। উমর আলি আর পাঁচজন দেহরক্ষী পেছনে নিয়ে ছেলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। শিঙা ফুকার সাথে সাথে আজম কামরায় ঢুকে সিংহাসনের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাকে বেশ স্বাস্থ্যবান আর তেজোদীপ্ত মনে হচ্ছে। তবে একয়েক বছরে তার চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েছে। চোখের নিচে কালো কালি পড়েছে। তার শরীরের অন্যান্য অঙ্গের মতো মুখও মাংসল হয়ে উঠেছে আর দাড়িতে সাদা ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছে।
‘স্বাগতম বেটা। এসো, আমার বুকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধর। প্রাণপণ চেষ্টা করে আওরঙ্গজেব বেতের লাঠি বাদ দিয়ে সিংহাসনের হাতলের উপর ভর দিয়ে কোনোমতে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর তার ছেলের মোটাসোটা শরীর দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন। কয়েক মুহূর্ত পর তাকে ছেড়ে দিয়ে তিনি আবার ধপ করে সিংহাসনে বসে পড়লেন।
‘এত দিন পর আপনাকে দেখে আমার খুব ভাল লাগছে বাবা। আর খবরে যা শুনেছি তার চেয়ে আপনাকে অনেক ভালো দেখাচ্ছে।
‘আমি এখনও আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতে চাই। আমার এখনও অনেক পরিকল্পনা পূর্ণ করার আছে।
আজম বললেন, আপনার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য আমাকে সাহায্য করতে দিন। আমি আমার যথাসাধ্য ক্ষমতা দিয়ে আপনাকে সাহায্য করবো।
‘কয়েকদিন পর সে বিষয়ে কথা বলবো। এত তাড়াহুড়ার কিছু নেই। দীর্ঘ সফরের পর তোমার আর তোমার লোকজনের বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন আছে। তারপর রাজদরবারের পুরোনো বন্ধুদের সাথে মোলাকাত কর।
*
সম্রাটের ব্যক্তিগত কামরায় একা বসে উমর আলি আওরঙ্গজেবকে বললো, ‘জাঁহাপনা, আপনার কথামতো আমি আপনার ছেলের কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার সাথে ব্যক্তিগতভাবে আলাপ করতে পেরেছি।
‘বল, কি জানতে পারলে?’ অনেক বছর আগে উমর আলির বিশ্বস্ততা আর সেইসাথে তার সামরিক কুশলতা আর সাহসীকতার কারণে তিনি তাকে তার প্রধান দেহরক্ষী নিযুক্ত করেছিলেন। ম্রাটের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রয়োজনে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে মনের সূক্ষ্ম বুদ্ধি কিংবা চতুরতার প্রয়োজন নেই কিংবা আকাক্ষিতও নয়। যাইহোক এমুহূর্তে আর কেউ নেই যাকে তিনি বিশ্বাস করতে পারেন, আর যাকে দিয়ে তিনি জানার চেষ্টা করবেন যে, আজমের আহমেদনগরে আসার পেছনে কারণ কি তার বাবার স্বাস্থ্যের জন্য ব্যাকুলতা না কি আরো কিছু আছে।
‘জ্বী, জাহাপনা, আমার প্রথম স্ত্রীর পরিবারের সাথে সম্পর্কযুক্ত একজন সেনা কর্মকর্তার সাথে আলাপ হয়েছে। সে বললো, আজম খোলাখুলিভাবে উত্তরাধিকার বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। আর আপনার মৃত্যুর পর সিংহাসনে তার অধিকারের দাবি তুলে ধরার কথা বলেছেন। তাছাড়া সে আরো বলেছে, গুজরাট ছেড়ে আসার আগে তিনি যেসব জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদেরকে সেখানে রেখে এসেছেন, তাদেরকে তৈরি থাকতে বলেছেন, যাতে প্রয়োজন পড়লে তার সমর্থনে তারা যেন অল্পসময়ের ডাকে রওয়ানা দিতে পারে।’
‘আচ্ছা তাই নাকি? আর কিছু জানতে পারলে?
‘জ্বী। দাক্ষিণাত্যে আমার সাথে লড়াই করেছিল, তেমন একজন যুদ্ধ ফেরত সেনা-কর্মকর্তা বললো আজম তাকে জানিয়েছেন যে, তার ভাইদের সরিয়ে তাকে ক্ষমতায় বসাবার কাজে সে যদি তাকে সাহায্য করে তবে তিনি তাকে পদোন্নতিসহ জায়গির দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সে বললো শুধু সে একা নয় আরো অনেক কর্মকর্তাকেও এ ধরনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’
আওরঙ্গজেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি খুব ভাল কাজ দেখিয়েছ উমর আলি।’
*
ছেলের আসার দশদিন পার হওয়ার পর আওরঙ্গজেব পুরো দরবারের সামনে তাকে হাজির হতে বললেন। এই সভায় যোগ দেবার প্রস্তুতি নিতে শক্তির জন্য প্রার্থনা করলেন আর শক্তি সঞ্চয় করতে তিনি যতক্ষণ পারেন ঘুমিয়ে নিলেন, তারপরও প্রচণ্ড কাশি আর সেই সাথে শাসকষ্ট রয়েই গেল।