স্বামীকে সান্ত্বনা দেওয়া কিংবা তার মনে যে অশান্তি চলছে তা থেকে তার মন অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেবার মতো কোনো কিছু খুঁজে না পেয়ে এবার উদিপুরী মহল নিজেই কাঁদতে শুরু করলেন। তারপর তার একটি কথা মনে পড়তেই তিনি বললেন, আপনি পারিবারিক কবরগুলো জেয়ারত করতে চেয়েছিলেন। আর গতকাল বলেছিলেন সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা আরো জোরদার করার জন্য উত্তরে যেতে হবে। তাহলে ফিরতি সফরের প্রস্তুতি নেবার দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন না কেন? এতে যেমন আপনার সাম্রাজ্যের ভালোর জন্য কিছু করতে গিয়ে জাগতিক উদ্দেশ্য সাধন হবে আবার যে জায়গায় আপনি অনেক আগে ছোটবেলায় সবার সাথে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতেন, সেখানে গিয়ে আত্মার শান্তিও পাবেন। আওরঙ্গজেব একটি নিষ্প্রাণ হাসি দিলেন আর তাঁর চোখের পানিও থেমে এল। তিনি বললেন, হ্যাঁ। একজন মানুষ যতই বৃদ্ধ আর অনাচারী পাপী হোক না কেন, তার কিছু করার থাকে, বিশেষত যদি সে একজন শাসক হয়। আমি নিরাশ হব না–নিরাশ হওয়াটা পাপ। আজই রাজদরবারে ঘোষণা দেব এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা উত্তরের দিকে যাত্রা শুরু করবো।
২২. জেড পাথরের তসবিহ
মার্চের শেষদিকের বিকেলে আহমেদনগরে প্রচণ্ড গরম পড়েছে। আওরঙ্গজেব কারও সাহায্য না নিয়ে হাতির দাঁতের হাতলওয়ালা দুটি বেতের লাঠির উপর ভর দিয়ে নগরদুর্গে তাঁর কামরার বেলকনিতে এলেন। গদিওয়ালা চেয়ারে বসতেই রোদ ঠেকাবার জন্য একজন পরিচারক তাঁর মাথার উপর একটি সবুজ রোদনিবারক ছাতা মেলে ধরলো। আরেকজন পরিচারক এক গ্লাস বরফ দেওয়া শরবত পাশে রাখলো আর তৃতীয়জন মসলিন কাপড়ে ঢাকা পিকদানিটি হাতের কাছেই রাখলো। তিন মাস আগে তার বুকের অসুখটি আবার এমন গুরুতর আকার ধারণ করেছিল যে, জ্বরে তিনি কাবু হয়ে পড়েন। তখন তিনি উদিপুরী মহলের অনুরোধে উত্তরের দিকে যাত্রা স্থগিত করতে রাজি হলেন। আবার পরিপূর্ণ সুস্থ হলে রওয়ানা দেওয়া যাবে। তারপর বেশ কিছু দিন বিশ্রাম নিয়ে স্বাস্থ্য কিছুটা ভাল হলেও এখনও তেমন শক্তি পান নি যে, সফরের ধকল পোহাতে পারবেন। ইতোপূর্বে ধূলিধূসরিত পথে পালকি দিয়ে এক মাইল চলার পর তিনি যেরকম কাহিল হয়ে পড়েছিলেন, সেরকম কাহিল যৌবনে ঘোড়ায় চড়ে অন্তত একশো মাইল গেলে হতেন। প্রতিটি ধাক্কা তার দেহমনের উপর এমন প্রভাব ফেলেছিল যে এর ফলে মাথায় যন্ত্রণা হত আর প্রতিটি হাড়ের ব্যথায় নিঘুম কাটতো। বৃদ্ধ বয়সের এই হচ্ছে পরিণতি।
দিল্লি এখনও প্রায় আটশো মাইল দূরে রয়েছে আর তার আশঙ্কা হচ্ছিল, তিনি বোধ হয় আর কখনও তার লাল বেলেপাথরের রাজধানী দেখতে পাবেন না। অন্যরাও তাই ভাবছিল। তিন সপ্তাহ আগে একজন কাসিদ খবর নিয়ে এসেছিল যে, বাবার গুরুতর অসুস্থতার খবর পেয়ে তার পাশে থাকার জন্য ছেলে আজম গুজরাট থেকে দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ে রওয়ানা দিয়েছে। আজ বিকেলেই তার পৌঁছার কথা আর সেজন্যই আওরঙ্গজেব তার আগমন দেখার জন্য বেলকনিতে এসেছেন। আবার গতকাল দাক্ষিণাত্য থেকে খবর এসেছে যে, মুয়াজ্জমও তার অসুস্থ বাবাকে দেখতে আসার পরিকল্পনা করছে। স্বভাবসুলভভাবে সাবধানী মুয়াজ্জম বলেছে সে ধীরে সুস্থে সাথে তার অনেক লোক নিয়ে আসবে। পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে, তার দুই ছেলেরই মনে উত্তরাধিকারের ভাবনা চলছে।
একই ভাবনাও কমবখস্ আর তার মা উদিপুরী মহলের মনেও চলছিল। মাত্র গতকালই তিনি ছেলেকে তার সামনে হাজির করে বলেছিলেন যে, বাংলার যে অশান্তি চলছে, তা দমন করার জন্য তিনি বিদেশি বণিকদের কাছে সামরিক সহায়তার বিনিময়ে পূর্ব উপকূলে আরো বন্দর খুলে দেবেন। অতিরিক্ত বাণিজ্যের ফলে রাজস্ব বেড়ে যাবে আর এতে স্থানীয় জনসাধারণের করের বোঝা কিছু লাঘব হবে। কমবখস্ তার প্রস্তাবটি তুলে ধরার পর, তার বাবার বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বার বার হোঁচট খেতে লাগলেন। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে সামনে খাড়া করা হয়েছে। তিনি বার বার সমর্থনের জন্য তার মায়ের দিকে তাকাচ্ছিলেন। উদিপুরী মহলের প্রতি আওরঙ্গজেবের আকর্ষণের একটি প্রধান কারণ ছিল তার সরলতা আর রাজনৈতিক ব্যাপারে তার অনাগ্রহ। তার সুন্দর বাহুতে তিনি জাগতিক সমস্যা ভুলে যেতে পারতেন। তিনি জানেন এখনও তিনি তার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও, কমবখসের বার বার হোঁচট খাওয়া সত্ত্বেও তাকে সেরকম সমর্থন যোগাতে পারেন নি।
আওরঙ্গজেব তাদেরকে জানালেন না যে, পাঁচবছর পূর্বে ইংরেজ রাষ্ট্রদূত নরিস যখন তাকে একই ধরনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তখন তিনি তার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন। কেননা বণিকরা ইতোমধ্যেই উদ্ধত হয়ে উঠেছিল আর মোগল শাসনকে অবজ্ঞা করতে শুরু করেছিল, কাজেই তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য আর উৎসাহিত করার প্রয়োজন নেই। এরপর কমবখস্ আর তার মা কিছু উদ্ভট আর অবিশ্বাস্য পরিকল্পনার কথা বলতে শুরু করলেন। কমবখস্ নিজে অবশ্য তার মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে যুদ্ধক্ষেত্রে যে বেশ সফলতা অর্জন করেছে তা জানিয়ে নিজের অবস্থান আরো সুবিধাজনক করতে পারত। সম্প্রতি তিনি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ছোট ছোট কয়েকটি লড়াইয়ে জয় পেয়েছিলেন।