“কি হয়েছে জান?
‘আমার বোন গওহারা মার গেছেন। একজন কাসিদ খবরটি এনেছে।
‘শুনে খুব খারাপ লাগছে। আল্লাহ তার বেহশত নসিব করুন। উদিপুরী সামনে এগিয়ে তার স্বামীর কাঁধ এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। আওরঙ্গজেবকে হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠতে দেখে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। তার সবচেয়ে ছোট বোনকে তিনি অনেক বছর দেখেন নি আর তারা তেমন ঘনিষ্ঠও ছিলেন না। সম্ভবত তাকে জন্ম দিতে গিয়ে তার মা মারা গিয়েছিলেন এই কারণে। তিনি বললেন, কাঁদবেন না। আল্লাহ সিদ্ধান্ত নেন কে কখন এই পৃথিবী ছেড়ে যাবে। তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন ধার্মিক এবং অনেক দাঁতব্য কার্যকলাপে জড়িত ছিলেন। তার অবশ্যই বেহেশতে স্থান হবে, আমি নিশ্চিত।
‘আমিও তাই মনে করি। তবে শোকটা শুধু বোন হারাবার জন্য নয়, যদিও এই শোকও গভীর। আমরা দুজন ছিলাম, আমার বাবা আর মায়ের ভালোবাসা থেকে জন্ম নেওয়া চৌদ্দজন সন্তানের মধ্যে সর্বশেষ জীবিত সন্তান। আমার মনে হয় আমার দুঃখ হচ্ছে তাদেরকে আর তাদের কিছু সন্তানদের হারিয়ে, যারা অল্পবয়সে মারা গিয়েছিল আর বাদ বাকিদের ভাগ্যে কি হয়েছিল তুমি জান…’
‘আপনার একথা ভেবে খুশি হওয়া উচিত যে আপনার বাবা আর মায়ের মাঝে এমন চমৎকার বন্ধন ছিল আর তাদের মৃত্যুর পর যা হয়েছিল তা আপনি বদলাতে পারেন না।
‘আমার এই বয়সে আমার মনে মৃতদের কথাই কেবল ভিড় করছে। সেটা সবসময় মন্দ নয়। তবে এই মাসগুলোতে যখন অসুস্থ হয়ে জেগে থাকতাম, তখন অনেক সময় ভাবতাম, পরিবারের মাঝে আমার অনেক কিছু বলার ইচ্ছা ছিল কিংবা করার ইচ্ছা ছিল–কিংবা যা বলা হয়নি কিংবা করা হয়নি–সেসব ভেবে এখন মনে দুঃখ হচ্ছে। অনেক সময় আমি ভাবতাম, গওহারাকে জন্ম দেবার সময় আমার মা যদি মারা না যেতেন, তবে হয়তো তিনি তার ছেলেদের মাঝে এই বিবাদ হতে দিতেন না। তবে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বাঘের বাচ্চারা যেমন নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই করে সেরকম এটিও কি অবশ্যসম্ভাবী ছিল?
‘আপনার পরিবারে ভাইয়ে ভাইয়ে প্রায়ই লড়াই করে থাকেন। তৃণভূমিতে আপনার পূর্বপুরুষরা প্রায়ই উচ্চারণ করতেন, “সিংহাসন কিংবা কফিন” একথাটা আপনি প্রায়ই আমাকে বলতেন, মনে আছে?”
‘তবে তা দিয়ে এই ধরনের লড়াইয়ে আমার অংশগ্রহণকে সঠিক কিংবা ন্যায্য প্রতিপন্ন করা যায় না। আমি বার বার দুঃস্বপ্ন দেখেছি যে, আমার মা দারা শিকোর খণ্ডিত মাথা কোলে নিয়ে কাঁদছেন আর আমার বাবা, জাহানারাকে পাশে নিয়ে কারাগারের শিকের ফাঁক দিয়ে দুহাত বাড়িয়ে আমার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাচ্ছেন। সমস্ত মন আর শরীর কাঁপতে কাঁপতে আমি জেগে উঠি আমার সত্তার একেবারে অন্তঃস্থলে এক বিশাল শূন্যতা নিয়ে…’
‘হেকিম আপনাকে যে ওষুধ দিয়েছে সে কারণে এটা হচ্ছে। আমি জানি ওরা আপনাকে ঘুম পাড়াতে অনেক সময় আফিম মিশিয়ে দেয় আর এতে আপনি এ ধরনের অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছেন।
হয়তো তাই। তবে একজন মানুষের স্বপ্ন তার চিন্তার ফসল। এই মাসগুলোতে আমি কয়েকবার জীবন ফিরে পেয়েছি। সাম্রাজ্য যেভাবে শাসন করেছি, তাতে আমি মোটেই অনুতপ্ত নই, যদিও মাঝে মাঝে বেশ কঠোর হতে হয়েছিল। আমার প্রিয় বোন জাহানারা বলতেন বিশেষত বিধর্মীদের প্রতি আমার আচরণ কঠোর ছিল। তবে সাম্রাজ্য আর আমার ধর্মবিশ্বাসের জন্য যা সঠিক মনে করেছি তাই করেছি। একমাত্র আল্লাহই এর বিচার করবেন। তবে আমার পরিবারের প্রতি আমার আচরণের ব্যাপারে একই কথা বলতে পারবো না…হ্যাঁ, দারাকে আমি খারেজি বা নব্যতান্ত্রিক সন্দেহ করেছিলাম আর আমার বাবা তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের স্নেহে অন্ধ হয়ে তার কোনো ত্রুটি খুঁজে পান নি। তবে আমি যা করেছিলাম তা কি করা উচিত ছিল? তাদেরকে কি বুঝাতে পারতাম না? মুরাদ আর শাহ সুজা নির্বোধ ছিলেন, তবে তাদের মেরে ফেলার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমি কি ভাল কিংবা নৈতিকতার কারণে কাজগুলো করার ভান করছিলাম না? প্রকৃতপক্ষে আমি কি একজন মোনাফেকের মতো আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর ক্ষমতার লোভকে ঢেকে রাখছিলাম না? যা আমাকে ঠেলে নিয়ে চলছিল সুনিপুণ ভাবাবেগ নিয়ে…আমি কি আমার বাবার সিংহাসন দখল করতে উদগ্রীব ছিলাম না?
‘কেবল আল্লাহই আপনার মনের ভাবনা পড়তে পারেন।’
‘আমার ভয় হয় যখন তিনি আমার মনের কথা পড়বেন। তিনি দেখবেন একের পর এক আমি শুধু চেয়েছি। পরকাল আমার কঠিন শাস্তির আর যন্ত্রণাময় হবে।’
‘আপনার ভালোকাজগুলো নিশ্চয়ই আপনার পাপকে ঢেকে দেবে।
‘এটা কেবল আশাই করতে পারি। আর যে কদিন বেঁচে থাকবো তার অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য সচেষ্ট থাকবো। আমার পরিবারের মৃত সদস্যদের আত্মার শান্তির জন্য তাদের কবরে প্রার্থনা করে যাব। এমনকি দিল্লিতে সম্রাট হুমায়ুনের বিশাল মাজারের চত্বরে দারা শিকোর কবরও জেয়ারত করবো। তবে ঘাড়ের উপর মৃত্যুর কংকালসার হাতের স্পর্শ অনুভব করে মনে হয়, তা হয়তো যথেষ্ট নয়…সেজন্য আমার দীনতা দেখাবার জন্য ইসলামি টুপি সেলাই করে বিক্রি করবো। আর এই টুপিগুলো বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া যাবে তার বেশি যেন আমার মৃত্যুর পর দাফন-কাফনে খরচ করা না হয়। আমি চাই না আমার কবরের উপর বিশাল কোনো সমাধিসৌধ নির্মাণ করা হোক, ঠিক প্রথম সম্রাট বাবরের যেমন কাবুলে খোলা আকাশের নিচে কবর হয়েছে, সেরকম একটি অতিসাধারণ কবর আমার জন্য হবে। এছাড়া আল্লাহর আর তার নির্দেশের প্রতি আমার ভালোবাসা দেখাতে আমি নিজ হাতে পবিত্র কুরআনের নকল লিখতে শুরু করেছি। তারপরও আমার মনে স্বস্তি নেই।’