হঠাৎ আওরঙ্গজেব তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, কে, উদিপুরী মহল?
তিনি বললেন, “জ্বী, আমি এখানে আছি। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ কথাটা বলা শেষ করার আগেই আওরঙ্গজেবের সারা শরীর ঘামে ভিজে গেল, পোশাকে গাঢ় দাগ দেখা দিল। আল্লাহকে শুকরিয়া যে জ্বর চলে গেছে। তিনি হয়তো বেঁচে যাবেন। উদিপুরী মহল তার ভেজা গালে চুমু খেলেন। এখন আর কালো পোশাকপরা ইমামের দোয়া পড়ার প্রয়োজন নেই।
দুদিন পর সকালবেলা উদিপুরী মহল আবার আওরঙ্গজেবের বিছানার পাশে বসেছিলেন। তিনি সবে মাত্র জেগে উঠেছিলেন আর উদিপুরী পাশে রাখা রুপার বোল থেকে একটি চামচে করে হেকিমের তৈরি করা পানি, মধু আর ভেষজের মিশ্রণ তুলতে যাচ্ছিলেন। তাঁর কাশি কমাবার জন্য হেকিম এটা দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব বললেন, ‘চামচের দরকার নেই। তুমি বোলটা দাও, আমি ওটা থেকে চুমুক দিয়ে খাব।
মৃদু হেসে তিনি বোলটা আওরঙ্গজেবের হাতে তুলে দিলেন। কাঁপা কাঁপা হাতে তিনি বোলটা ধরলেন। তারপর ভেষজের মিশ্রণটা খাওয়ার পর বললেন, ‘আমাকে ধরে বালিশে হেলান দিয়ে বসাও। সামান্য চেষ্টাতেই উদিপুরী তাকে টেনে তুলে বালিশে হেলান দিয়ে প্রায় খাড়া করে বসালেন। পেছনে কয়েকটা মোটা রেশমি বালিশ রাখতেই তিনি বললেন, ‘জলদি কাশ্মিরি শালটা দাও আমার হাতে! বেশ শীত করছে সকালের বাতাসে।
তিনি তার পুরনো কর্তৃত্বব্যঞ্জক আচরণ কিছুটা ফিরে পেয়েছেন দেখে উদিপুরী মহল খুশি হয়ে বললেন, আপনি আবার শক্তি ফিরে পাচ্ছেন দেখে আমার ভাল লাগছে।’
‘হ্যাঁ। আজ সকালে আবার নামাজ পড়তে পারবো। বিকেলে পোশাক পরে পালকিতে চড়ে দিওয়ান-এ-খাসে গিয়ে সভাসদদের সাথে একটি সভায় মিলিত হব।
সভায় অংশগ্রহণ করে শরীরের উপর চাপ দেবার দরকার নেই।
‘অবশ্যই প্রয়োজন আছে। এখন থেকে প্রতিদিন আমি সভাসদদের সাথে অলোচনায় যোগ দিতে চাই। এতে আমার অমাত্য, উপদেষ্টারা জানবে আমি শুধু বেঁচে নেই পুরাপুরি মন দিয়ে কার্যকরভাবে শাসনকাজ চালাতে সক্ষম। গত রাতে যখন আমি জেগে ছিলাম তখন আমার মনে পড়েছিল, পঞ্চাশ বছর আগে যখন খবর এল আমার মধ্য ষাটের বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়েছেন, তখন আমিসহ আমার ভাইয়েরা সবাই মনে করলাম তিনি আর শাসন করার উপযুক্ত নন। আর সিংহাসনের জন্য নিজেদের দাবি নিয়ে এগোবার সময় এসেছে। পুরোনো কথা আর বলবো না। এখন মুয়াজ্জম আর আজমকে চিঠি লিখে জানাব আমি সুস্থ হয়েছি।’
উদিপুরী মহল মাথা নাড়লেন। তাকে সুস্থ হতে দেখে আর তার মনোবল ফিরে এসেছে দেখে তিনি খুশি হলেন। শুধু তাই নয়, এ খবরটি পেয়েও খুশি হলেন যে, তিনি উত্তরাধিকারীর বিষয়টি নিয়ে এখন অগ্রসর হতে পারেন। চাকর বাকর আর হেরেমের অন্যান্যের কাছ থেকে কানাঘুষা শুনেও তিনি এ বিষয়ে আরো নিশ্চিত হয়েছিলেন। এখন তাকে সুযোগ বুঝে উত্তরাধিকার হিসেবে কমবখস্রে যোগ্যতার কথাটা তুলে ধরে তাঁকে রাজি করাতে হবে। তাকে এখন তার স্বামীর সেবাযত্ন করে তাকে সুস্থ করে তুলতে হবে।
*
বার বার বৃষ্টি হওয়ায় দেবপুর আর এর আশেপাশের এলাকা আরো গাঢ় সবুজ হয়ে উঠেছে। বাইরে দুর্গে বাগানে সবুজ ফলের গাছের মাঝে ফোয়ারায় পানির বুদবুদ উঠছে আর প্রথম গোলাপ ফুটেছে। সেদিকে তাকিয়ে উদিপুরী মহল ভাবলেন, এখনও রাজদরবার এখানেই রয়েছে। যখনই আওরঙ্গজেব হাজার মাইল দূরত্বে দিল্লি যাওয়ার দীর্ঘ সফরের কথা তুলেন, তখনই তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবে প্রথম বারের জ্বরের পর ছাড়া প্রতিদিন তিনি দরবারের সভায় যোগ দিয়েছেন, তবে মাঝে মাঝে এমন শক্তি ক্ষয় হয় যে, এরপরে সারাদিন বিছানায় শুয়ে কাটান। এই ধরনের মনোবল দেখাবার কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেও, এতে একটি উদ্দেশ্য সাধন হয়েছিল। উত্তরাধিকারত্ব নিয়ে বেশিরভাগ গোপন ষড়যন্ত্র দমন করা গেছে। এমনকি যখন একজন সেনাপতি বোকার মতো মন্তব্য করেছিল যে, সে আর তার সৈন্যরা সিদ্ধান্ত নেবে কে সিংহাসনে বসবে, তখন তিনি একথা শোনার পর তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলেন।
এই মুহূর্তে তিনি কিছু সময়ের জন্য ভালো বোধ করছিলেন। কাশি কমে গিয়েছে আর ক্ষুধাও বেড়েছে। আবার সফর শুরু করার কথা তুললেন। এবার উদিপুরী মহল আগের চেয়ে আরো উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। বছরের এই সময় সফরের জন্য খুবই উপযুক্ত, দিনের বেলা বেশ ঠাণ্ডা হচ্ছে, বৃষ্টি আর গুমোট আবহাওয়ার আশঙ্কাও তেমন নেই।
দীর্ঘদেহী একজন তরুণী পরিচারিকা তার চিন্তার সূত্র ভেঙ্গে দিয়ে বললো, ‘বেগম সাহেবা, সম্রাট আপনাকে তার কাছে যেতে বলেছেন।
‘তিনি কী আবার অসুস্থ হয়েছেন?
‘আমার মনে হয় না বেগম সাহেবা। আমি শুনলাম, আপনাকে ডেকে পাঠাবার ঠিক আগে একজন কাসিদ এসেছে–সম্ভবত এমন কোনো খবর এসেছে যা তিনি আপনাকে জানাতে চান।
হাতের কাছে সবসময় যে ছোট রূপার আয়নাটি তিনি রাখেন, তাতে একবার চেহারা দেখে ঠিক করে নিলেন, যাতে স্বামীর কাছে তাকে সুন্দর দেখায়। তারপর তিনি তার ঘর থেকে বেরিয়ে পর্দাঘেরা করিডোর দিয়ে আওরঙ্গজেবের কামরার দিকে চললেন। একজন প্রহরী পর্দা সরিয়ে দিতেই তিনি ভেতরে ঢুকলেন। আওরঙ্গজেব একটি চেয়ারে সোজা হয়ে বসে রয়েছেন, বাম হাতে একটা কাগজ ধরে রয়েছেন, চোখে পানি।