কোনো উত্তর নেই।
“ঠিক আছে, তোমাদেরকে একজন একজন করে ঐ কামানের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর কামানের মুখে তোমাদেরকে বেঁধে গোলা ছোঁড়া হবে, তোমাদের দেহ টুকরা টুকরা হয়ে উড়ে যাবে। তারপর একটি মুণ্ড ঐ দুর্গের কোনো একটি চূড়ায় সিমেন্ট করে রাখা হবে, যাতে এটা দেখার পর অন্যরা সাবধান হয় আর আমার কর্তৃত্বকে মানতে বাধ্য হয়। প্রহরী, গোলন্দাজ সেপাই, কাজ শুরু করে দাও!’
নদীর ওপারে সূর্য অস্ত যেতেই দুইজন দীর্ঘদেহী প্রহরী লম্বাচুলের একজন মারাঠিকে ধরে তাকে টেনে-হিঁচড়ে কামানের দিকে নিয়ে চললো। লোকটি কোনো বাধা দিল না, তবে মাথা সোজা করে রইল আর আওরঙ্গজেবের কাছে। আসতেই চিৎকার করে উঠলো, হিন্দুস্তান আমাদের দেশ। এক দিন আমরা আপনার এবং সকল বিদেশি হামলাকারীদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হব। এখন আমি যত যন্ত্রণা আর অপমান বোধ করবো, হে বৃদ্ধ, আপনার বংশধরেরা তার চেয়ে দশগুণ বেশি যন্ত্রণা ভোগ করবে। একজন প্রহরী তার তলপেটে প্রচণ্ড আঘাত করতেই সে উল্টে পড়লো, তবে একটুও শব্দ করলো না। কামানের কাছে পৌঁছে প্রহরীরা কামানের মুখের উপর তার শরীর বাঁকা করে ধরলো আর হাত-পা রশি দিয়ে কামানের নলের সাথে বাঁধলো। কামানের পাশে দাঁড়ান তিনজন গোলন্দাজ সেনা ইতোমধ্যে কামানে গোলা ভরে রেখেছিল। লোকটি তারপরও কোনো ধরনের নড়াচড়া করলো না কিংবা চিৎকার করলো না। প্রধান গোলন্দাজ সেনা বারুদে আগুন ধরাতেই কামানের গোলাটি মারাঠি লোকটির দেহ ছিন্নভিন্ন করে দিল। অনেক দূরে চতুর্দিকে রক্ত, মাংস আর হাড় ছড়িয়ে পড়লো। আর মাথাটি গড়াতে গড়াতে নদীর তীরের দিকে গিয়ে পৌঁছল।
আওরঙ্গজেব উমর আলিকে বললেন, ‘বেহারাদের ডাক। আমার এসব দেখার দরকার নেই। এই লোকগুলোর মনোবল ভেঙ্গে দেবার জন্য তিনি আর কি করতে পারেন?
*
দেবপুর দুর্গ-প্রাসাদের ধূলিধূসরিত উঠানে পালকির পাশে হাঁটুগেড়ে বসা দেহরক্ষী প্রধানকে আওরঙ্গজেব বললেন, আমাকে কয়েকটা দিন অবশ্যই বিশ্রাম নিতে হবে। আমার মনে হয় আমি আমার শক্তির শেষ সীমায় এসে গেছি, দিল্লি রওয়ানা দেবার আগে আমাকে সুস্থসবল হয়ে উঠতে আরো কিছু সময় দিতে হবে। তবে দিল্লি যেতেই হবে। উমর আলি প্রয়োজনীয় নির্দেশ দাও।’
“জ্বী, জাঁহাপনা। আমি সেনাপতিদের বলবো ওরা যেন সৈন্যদের বেশ কিছু দিন থাকার মতো রসদের মজুদ এবং মোটামুটি স্থায়িভাবে থাকার বন্দোবস্ত নিশ্চিত করে।’
‘আর বিভিন্ন প্রদেশের সুবেদার আর সেনাপতিরা যেন জানে…’ হঠাৎ কাশির দমকে আওরঙ্গজেব থেমে গেলেন। এক টুকরা মসলিন কাপড় দিয়ে ঢাকা পাশে রাখা চিনামাটির একটি পেয়ালায় এক দলা কফ থুক করে ফেলে তিনি আবার কর্কশ স্বরে বলতে লাগলেন, “ওদেরকে জানাও আমি এখানে আছি, কোনো ধরনের সমস্যা হলে যেন দ্রুত আমাকে খবর দেয়।
‘আমি বলবো জাঁহাপনা। আমি কি আপনাকে পালকি থেকে উঠতে সাহায্য করবো, যাতে আপনি হেঁটে আপনার থাকার কামরায় যেতে পারেন? আমার মনে হয় পরিচারকরা কামরাগুলো সাজিয়ে রেখেছে।
না, এখন আমি হাঁটতে পারবো না, এবার খুব ক্লান্ত হয়েছি। বেহারাদের বল পালকিটা ভেতরে বয়ে নিয়ে যেতে আর চাকরদের বল কিছু বরফ পানি প্রস্তুত করতে। যদিও ঘাম নেই, তারপরও আমার শরীরের ভেতরে আগুনের মতো গরম মনে হচ্ছে।
‘অবশ্যই জাঁহাপনা। আমি নিশ্চিত বরফঘরটিতে প্রচুর বরফ রয়েছে। উদিপুরী মহল খবর পাঠিয়েছেন, তিনি আপনার জন্য আপনার কামরায় অপেক্ষা করছেন। আমি পরিচারকদের বলবো জানালায় লেইসের সুতার পর্দা লাগিয়ে পানি দিয়ে যেন ভিজিয়ে রাখে।
“ঠিক আছে। এখন বেহারাদের বল পালকিটা ঘরের ঠাণ্ডায় আমাকে নিয়ে যেতে।’ কথাগুলো বলতেই আবার কাশির দমকে তাঁর শীর্ণ দেহটি কেঁপে উঠলো।
প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে দিতে উমর আলি ভাবলো তিনি নিশ্চয়ই অসুস্থ হয়েছেন। আওরঙ্গজেবকে তিনি কখনও এরকম তাঁর কর্মচারীদের সামনে নিজের শারীরিক দুর্বলতা প্রকাশ করতে দেখেন নি।
সেদিন সন্ধ্যায় উদিপুরী মহল আওরঙ্গজেবের উপর ঝুঁকে তাঁর দিকে তাকালেন। দেবপুরের সন্ধ্যার বাতাসে ঘরে ফেরা ময়ূরের কর্কশ কেকা ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। দুর্গের সাদা মার্বেল পাথরের যে প্রাসাদে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেখানে পৌঁছার কিছুক্ষণ পরই আওরঙ্গজেব ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুমের মাঝে বার বার মাথা উঁচু করে এদিক ওদিক পাশ ফিরছিলেন। পাশে রাখা রূপার বাটি থেকে পানি নিয়ে উদিপুরী তার শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে দিচ্ছিলেন। তিনিও খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন আর ঘুমে তার চোখ বুজে আসছিল এমন সময় হঠাৎ আওরঙ্গজেবকে কথা বলতে শুনে তিনি চমকে জেগে উঠলেন। মা, আমাকে বাঁচাও। আমার যন্ত্রণা হচ্ছে। চারপাশে শুধু সাপ…সাপ আমার মাথায়…সাপ আমার পরিবারে…বিষ ঝরে পড়ছে তাদের বিষদাঁত থেকে। আমাকে ছেড়ে চলে যেও না, সাপ আমাকে কামড়াবে। বাঁচাও! বাঁচাও আমাকে!’ তিনি চারপাশে হাত তুলে ছুড়ছিলেন। দুচোখ খোলা আর চোখের মণি উন্মাদের মতো ঘুরছিল। তিনি প্রলাপ বকতে শুরু করেছেন। তিনি কী মারা যাচ্ছেন?
পাশে দাঁড়ান একজন তরুণ কোরচিকে উদপুরি মহল বললেন, ‘হেকিমকে ডেকে আন আর কাউকে পাঠিয়ে দোয়া পড়ার জন্য ইমামকে খবর দাও।’ তারপর তিনি পাশে রাখা বড় একটি বোল থেকে বড় এক টুকরা বরফ নিয়ে আওরঙ্গজেবের কপালের উপর ধরলেন। বরফগলা পানি ফোঁটায় ফোঁটায় তার মুখ বেয়ে সাদা দাড়িতে পড়তেই তিনি আবার এক মুহর্তের জন্য প্রচণ্ডভাবে কেঁপে উঠলেন তারপর আবার বিছানায় শুয়ে স্থির হয়ে রইলেন। কপালে হঠাৎ ঠাণ্ডা বরফ রেখে কি তিনি তাঁকে প্রচণ্ডভাবে একটা ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলেছেন? না, তার বুক তো ঠিকই উঠানামা করছে।