চার-পাঁচজন দেহরক্ষী ঘোড়ার রাশ টেনে তাদের ঘোড়া থামাল। তারপর দ্রুত ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে শাহজাদার উপরে ঝুঁকলো। বাকি মোগল সৈন্যরা ঢাল বেয়ে দুর্গের দিকে ছুটে চললো। মাটির দেয়াল টপকাতে গিয়ে দুটি ঘোড়া পড়ে গেল, অন্যরা দেয়াল টপকে দুর্গের ভেতরে ঢুকে পড়লো।
আওরঙ্গজেব চিৎকার করে বললেন, ‘হেকিমকে পাঠিয়ে আমার ছেলেকে পেছনের সারিতে নিয়ে আসতে বল। আর দেখো তার পড়ে যাওয়ার খবরটা যেন মেয়েদের কানে না যায়। ওরা কাফেলার পেছনে পর্দাঘেরা হয়ে আসছিল আর যখন মারাঠিরা অতর্কিতে আক্রমণ করেছিল তখন প্রহরীরাও ওদেরকে ঘিরে ছিল, কাজেই উদিপুরী মহল দেখতে পারেন নি কি ঘটেছে। আমি আমার ছেলের কতটুকু জখম হয়েছে দেখার পর নিজে তাকে খবরটা জানাব।’
হুমায়ুনের আমল থেকে কোনো মোগল শাহজাদা যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যান নি। তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন, তিনি যেন কমবখসের প্রাণ রক্ষা করেন। তার মনে পড়লো ছোট ছেলের জন্মের সময় তিনি ভেবেছিলেন একজন সম্রাটের বেশ কয়েকটি ছেলের প্রয়োজন, কারণ কেউ হয়তো মারাও যেতে পারে কিংবা কেউ বিশ্বাসঘাতকতাও করতে পারে। সেই তখন থেকেই তিনি আকবরের বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করে এসেছেন। এখন কি তাকে আরেকটি মৃত্যু সহ্য করতে হবে? অবশ্য সেটা এখনই জানা যাবে। কমবখসের চারদিকে যে দেহরক্ষীরা ভিড় করেছিল, তাদের মধ্যে একজন ঘোড়ায় চড়ে শিবিরের দিকে ফিরে আসছিল। শীঘ্রই সে আওরঙ্গজেবের সামনে এসে ঘোড়া থেকে নামলো। তার মুখ দেখে কিছু বোঝা গেল না।
‘আমার ছেলে সে কেমন আছে?
‘আমরা নিশ্চিত কিছু বলতে পারছি না জাহাপনা। একটি মারাঠি গোলা তার ঘোড়াকে আঘাত করেছিল, তাকে নয়। তবে মাটিতে পড়ে যাওয়ার সময় তার শিরস্ত্রাণটি খুলে পড়ে এবং শক্ত পাথুরে জমিনে তার মাথা ঠুকে যায়। তার নাক, মুখ আর এক কান দিয়ে রক্ত পড়ছে। জ্ঞান হারালেও তার নিশ্বাস-প্রশ্বাস ঠিকই বইছে। আর আমাদের একজন সাথি বলেছে তিনি নাকি একবার চোখের পাতা ফেলেছিলেন। হেকিম বলেছেন তাকে এখন যেখানে আছেন সেখানে রাখাই ভাল। ওরা বরফ আর কম্বল আনতে বলেছে।
কিন্তু ওকে ওখানে রাখলে মারাঠিরা কিছু করবে না?
দুর্গ থেকে যারা পালাতে পারে নি তাদের সকলকে বন্দী করা হয়েছে। সবকিছু এখন শান্ত।
কয়জনকে ধরেছ?
‘প্রায় পঁচিশজন হবে, জাহাপনা।
‘ওদেরকে কড়া পাহারায় রাখে। পরে আমি ওদের সাথে কথা বলবো। এখন আমাকে আমার ছেলের কাছে যেতে হবে। উমর আলি, একটা পালকি আনতে বল।
দশ মিনিট পর ছয়জন বেহারা পর্দাঘেরা পালকিটি কমবখকে ঘিরে থাকা সেনাদলটির কাছে এসে নামাল। ভিড়ের ফাঁক দিয়ে বিশেষ কিছু দেখা যাচ্ছে না। ষাট বছরের উমর আলি পালকির সাথে সাথে ছুটে এসেছে। সে আওরঙ্গজেবকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো।
‘আমাকে দেখতে দাও আমার ছেলেকে। যারা কমবখসূকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল তারা সরে দাঁড়াল। আওরঙ্গজেব নিচে তাকিয়ে দেখলেন কমবখস্ এখন মনে হল অজ্ঞান হয়ে রয়েছেন। নাক মুখ থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে, তবে অন্তত তিনটি দাঁত ভেঙ্গে গেছে আর তার বাম হাতের কব্জির একটি রক্ত মাখা হাড় বেরিয়ে রয়েছে। কালো পোশাকপরা একজন হেকিম কাপড়ে মোড়ান একটি বরফের টুকরা নিয়ে তার ছড়ে যাওয়া কপাল, আর ফুলে বেগুনি হয়ে যাওয়া বাম চোখে ধরে রেখেছিলেন। তবে সকল প্রশংসাই আল্লাহর, তার ছেলের বুক উঠানামা করছিল। সে ঠিকমতোই নিশ্বাস নিচ্ছিল।
আওরঙ্গজেব হেকিমকে জিজ্ঞেস করলেন, “সে কি একবারও নড়েছে?
‘দুই তিন মিনিট আগে তিনি একবার চোখ মেলে তাকিয়েছিলেন, এমনকি মনে হলো মৃদু হেসেছিলেন। তবে এর পর আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। হেকিম কথা বলতে বলতেই কমবখ মাথাটা সামান্য নড়ে উঠলো। তিনি আবার চোখ খুললেন আর মনে হল তার বাবার দিকে তাকালেন।
আওরঙ্গজেব জিজ্ঞেস করলেন, কমবখস্, তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?” তার ছেলে কোনো উত্তর দিল না, তবে তার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে কয়েক ফোঁটা রক্ত বের হয়ে তার কালো দাড়ির উপর গড়িয়ে বের হল–সম্ভবত মাথা নাড়াচাড়ার কারণে কোনো একটি জখম খুলে গেছে। আবার চোখ বন্ধ করলেন। আরো পাঁচ মিনিট কেটে গেল, তারপর আবার কমবখসের চোখের পাতা কেঁপে উঠলো, তিনি আবার চোখ খুললেন। এবার আওরঙ্গজেব নিশ্চিত হলেন তিনি তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন। তিনি ডেকে উঠলেন, ‘কমবখস্…?
তিনি আর কিছু বলার আগেই কমবখসের রক্তমাখা ঠোঁট নড়ে উঠলো। মৃদুস্বরে তবে পরিষ্কারভাবে তিনি বলে উঠলেন, ‘বাবা?’
হাঁটুর ব্যথা নিয়ে আওরঙ্গজেব সাথে সাথে সেখানেই হাঁটুগেড়ে বসে পড়লেন, সকল প্রশংসাই আল্লাহর!
দুই ঘণ্টা পর কমবখসের ভাঙ্গা কব্জিতে পট্টি লাগাবার পর তাকে একটি নতুন তাবুতে বসিয়ে পাশে উদিপুরী মহলকে রেখে আওরঙ্গজেব আবার পালকিতে চড়ে নদীর তীরে ফিরে এলেন। সেখানে চব্বিশ জন মারাঠি বন্দী হাত-পা পিছমোরা বাঁধা অবস্থায় একই দেহরক্ষীদলের পাহারায় অপেক্ষা করছিল। পালকিতে নেমে তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে বন্দীদের কাছে হেঁটে গেলেন। প্রায় সবাই তার দিকে অম্লানবদনে তাকিয়ে রইল।
“তোমরা সবাই তোমাদের সম্রাট–আমার কাছে বিশ্বাসঘাতক। তোমাদের মতো লোকেরা আমার শাসনে বার বার উপদ্রব সৃষ্টি করেছ। কেউ তোমাদের মৃত্যু ঠেকাতে পারবে না, তবে তোমরা যদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ কর, তবে ঘাতকের তরোয়ালের এক কোপে তোমাদের মৃত্যু দ্রুত, যন্ত্রণাহীন এবং যতদূরসম্ভব মর্যাদাপূর্ণ হবে। এটা জানার পর তোমাদের মধ্যে কেউ কী সত্যি ধর্মে দীক্ষিত হতে রাজি আছ?