‘সেটা হয়তো পুরোপুরি সম্ভব নয়। আমি একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেটা সেনাপতিদের সামনে ঘোষণা করার আগে তোমাকে বলতে চাই। কিছু সৈন্য নিয়ে আমি উত্তরে আগ্রা আর দিল্লির দিকে ফিরে যাব। তেইশ বছর যাবৎ দক্ষিণে থেকে আমাদের সাম্রাজ্যের পরিধি এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাড়িয়েছি। এখানে যে বিরাট সেনাবাহিনী থাকবে তার নেতৃত্ব দেবার জন্য মুয়াজ্জমকে ডেকে আনবো। সে একজন কুশলী সেনাপতি আর একটি ভুলের পর নির্দেশের প্রতি সে আরো অনুগত হয়েছে। তার কাজ হবে আমাদের এখানকার অবস্থান ধরে রাখা। আর কোনো এলাকা দখল করার দরকার নেই। আজম গুজরাটেই থাকবে।’
‘এসব সিদ্ধান্ত এখন কেন নিচ্ছেন?
‘অনেক কারণে। উত্তরে অশান্তি চলছে। রাজপুতরা উদ্ধত হয়ে উঠেছে আর শিখরাও আরো বেশি স্পর্ধা দেখাচ্ছে। এমনকি জাটরাও আগ্রায় আমার মায়ের সমাধিসৌধে লুটপাট চালিয়েছে। তার উপর আমার নিজের যে কর্মকর্তাদের চোখের আড়ালে রেখে আমি বিশ্বাস করেছিলাম, ওরাও দুর্নীতিপরায়ণ আর অর্থলোলুপ হয়ে উঠেছে। আমি এদের কয়েকজনকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেব, যাতে অন্যরা সাবধান হয়ে যায়। আর খাজনার পরিমাণ বাড়িয়ে তুলবো, যা আমার সেনাবাহিনীকে টিকিয়ে রাখার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আওরঙ্গজেব এতক্ষণ সোজা হয়ে বসে কথা বলছিলেন, এবার একটু থামলেন, তারপর আবার বলে চললেন, আর সত্যি বলতে কি, উত্তরে আবার পরিচিত লোকালয় আর দালানকোঠাগুলো আমার খুব দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে। ইচ্ছা হচ্ছে দিল্লিতে আমার বোন জাহানারার মাজারে দোয়া করার, আর আগ্রায় তাজমহলে মায়ের মাজারে আর হয়তো সেখানে বাবার কবরেও দোয়া করবো। আবার একটু থামলেন। আওরঙ্গজেবের এরকম বিষাদময় চেহারা উদিপুরী মহল আর কখনও দেখেন নি। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন তার লাল হয়ে আসা চোখে দু একফোঁটা পানি দেখা যাচ্ছে, ধীরে ধীরে গাল বেয়ে নেমে চোখের পানি সাদা দাড়ি ভিজিয়ে দিচ্ছে। তিনি তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে আবার বললেন, ‘যতই বয়স হচ্ছে ততই তার কথা আমার বেশি মনে পড়ছে। গত বছর পারস্যে আকবর মারা যাবার পর আর তার আগে কারাগারে জেরুন্নিসার মৃত্যুর খবরের পর আমার মনে যে শোক জেগেছিল, তা আমাকে অবাক করেছে। বয়স আমাকে বুঝতে শিখিয়েছে পিতামাতার সাথে তাদের সন্তানেন বন্ধন কত অসমান। বড় হলেই সন্তান তার বাবা-মার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায়, নিজের পরিকল্পনা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অথচ বাবা-মা তখনও সেই বন্ধন অনুভব করে আর ওদেরকে ছোট ছেলেমেয়ে হিসেবে দেখে। বুঝতে ব্যর্থ হয় কেন সন্তান তার কথামতো চলে না। যদিও আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই যে,…মোটেই নেই…যে আমি সবসময় সঠিক কাজই করেছি …যখন বাবার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছিলাম, আর এখন একটু একটু বুঝতে শুরু করেছি তিনি তখন কেমন অনুভব করেছিলেন।
কথা বলা শেষ করতেই একটি কষ্টের হাসি আওরঙ্গজেবের মুখে দেখা দিয়েই আবার মিলিয়ে গেল। উদিপুরী তার কাছে গিয়ে দুই হাতে তার কাঁধ ধরলেন। কয়েকমিনিট নীরবতার পর তিনি বললেন, কমবখস্ কি আমাদের সাথে উত্তরে যেতে পারবে?
‘হ্যাঁ, যদি তুমি চাও।’
‘আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। সে আমার বড় আদরের আর আমার মনে হয় আপনারও একজন প্রিয়পাত্র। সেজন্য অনেক সময় আমার দুশ্চিন্তা হয় হয়তো তার ভাইয়েরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারে, বিশেষত যখন সে আপনার নিরাপদ আশ্রয় থেকে দূরে থাকে…’
‘আমি যতদিন বেঁচে আছি আর আমি এত তাড়াতাড়ি মরতেও চাই না, এ ধরনের ষড়যন্ত্র হতে দেব না।’
উদিপুরী মহলের মাংসল মুখে একটি মৃদু হাসি খেলে গেল। আর তা আওরঙ্গজেবকে মনে করিয়ে দিল যৌবনে তিনি দেখতে কেমন ছিলেন। তার বুকে মাথা রেখে ধীরে ধীরে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। উদিপুরী মহল তার পাতলা হয়ে যাওয়া চুলে হাত বুলাতে বুলাতে তার মাতৃভূমি জর্জিয়ার একটি নৈশকালের ঘুমপাড়ানি গান গুন গুন করে গাইতে শুরু করলেন। আগামীকাল তিনি চাকরদের বলবেন তার সিন্দুকে মালপত্র ভরতে, কেবল সফরের উপযোগী কিছু পোশাক আর অলঙ্কার, যা তার স্বামীকে খুশি করবে সেগুলো আলাদা করে রাখবেন। তবে পোশাকগুলোতে কিছু পরিবর্তন করতে হবে, কেননা তিনি আগের চেয়ে বেশ মোটা হয়েছেন। আর সামান্য যে মদ লুকিয়ে রেখেছিলেন তা ফেলে দিতে হবে, কেননা তার স্বামী এটা খুবই অপছন্দ করেন। উত্তরে পৌঁছান পর্যন্ত তাকে ধীর-স্থির থাকতে হবে। আওরঙ্গজেবের বয়স এখন সাতাশি, কষ্টকর সফরকালে তার স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য উদিপুরীর সাহায্য প্রয়োজন হবে। কমবখও তার কর্মতৎপরতা আর সিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার হিসেবে তার যোগ্যতা প্রমাণ করার একটি সুযোগ পাবে। তবে তিনি নিশ্চিত অবশ্যই সে সময় আসবে…।
*
অশ্বারোহীদলের সবার আগে অগভীর নদীর পানি ছিটিয়ে কমবখস্ বীরের মতো আক্রমণে ছুটে চললো। শেষ বিকেলের আলোয় নদীর পানির রঙ সোনালি হয়ে চিক চিক করছিল। এক হাতে রোদ আড়াল করে আওরঙ্গজেব লক্ষ করলেন তার ছেলের পেছনের একজন অশ্বারোহী তার সাদা ঘোড়ার পিঠ থেকে দুই হাত ছুঁড়ে পানিতে পড়ে গেল। তবে কম বখস্ ইতোমধ্যে নদী পার হয়ে পাহাড়ের পেছনের পরিত্যক্ত দুর্গটি পর্যন্ত অর্ধেক পথ পার হয়েছে। এর নিচু মাটির দেয়ালটি বৃষ্টি পড়ে জায়গায় জায়গায় ভেঙ্গে পড়েছে, সহজেই ঘোড়াগুলো টপকে যেতে পারবে। শীঘ্রই দুর্গে যে মারাঠি সৈন্যগুলো লুকিয়েছে তারা ধরা পড়বে এবং মারা পড়বে। ওরা ধীর গতিতে চলা মোগল সেনাবাহিনীর অগ্রবর্তী দলের উপর অতর্কিতে হামলা করে এখানে লুকিয়েছিল। মারাঠিদের হাতে তার যে লোকেরা মারা গিয়েছিল, তাদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া হবে। দুই মাইল দীর্ঘ মোগল কাফেলার উপর এটা সর্বশেষ অতর্কিত হামলা ছিল, এমনিতেই ধীরে চলা কাফেলাটির অগ্রগতি আরো ধীর হয়ে পড়লো, কেননা এখন তাদেরকে প্রতিটি লোকের উপর কড়া নজর রাখতে হচ্ছে। তবে এখন পাহাড়ের ঢাল আরো খাড়া হয়ে চলেছে, কমবখস তার বাদামি ঘোড়ায় চড়ে দেহরক্ষীদের আগে আগে ছুটে প্রায় দুর্গের দেয়ালের কাছে পৌঁছে গেছে। হঠাৎ তার ঘোড়াটি পা ভাঁজ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই সেও জিন থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ে স্থির হয়ে রইল।