ত্রিশ মিনিট পর বজ্রদেব ধীরে ধীরে একটি ছোট টিলার উপর চড়লো। তাকে এখন আওরঙ্গজেবের সৈন্যদের অনেকেই দেখতে পাচ্ছে, শুধু তাই নয় যগিনগড় দুর্গ থেকেও তাকে দেখা যাচ্ছিল। দুর্গটি আরো বড় একটি পাহাড়ের উপর অবস্থিত ছিল, এর দুই পাশে পাহাড় চূড়া দিয়ে বেষ্টিত এবং পাশেই একটি চওড়া খরস্রোতা নদী বয়ে যাচ্ছে। দুর্গটি বড় না হলেও, পাথরের চওড়া দেয়ালটি অত্যন্ত শক্ত প্রমাণিত হয়েছিল। বজ্রদেব টিলার সমতল চূড়ায় উঠে দাঁড়াল। দুজন অশ্বারোহী পতাকাবাহক সোনালি ঘেরের দুটি সবুজ বিশাল পতাকা হাতিটির পেছনে মেলে ধরলো। আওরঙ্গজেব আদেশ করলেন, উমর আলি আমাকে আবার দাঁড়াতে সাহায্য কর।
প্রধান দেহরক্ষী তাকে দাঁড়াতে সাহায্য করে তার হাতে গাদা বন্দুকটা তুলে দিল। এর হাতির দাঁতের বাটে লড়াইয়ের দৃশ্য খোদাই করা ছিল। উমর আলি বললো, আপনি কি আমার কাঁধে রেখে বন্দুকটা নিশানা করবেন, জাঁহাপনা?’ আওরঙ্গজেব বললেন, ‘না, আমি এটা ধরে নিশানা করতে পারবো। ঠিকই তিনি তার কথামতোই কাজ করলেন। সমস্ত শক্তি দিয়ে গাদা বন্দুকটা সোজা করে দুর্গের দিকে একটি গুলি করলেন।
সাথে সাথে তার সম্মুখ সারি থেকে গুলির আওয়াজ শোনা গেল। কামানগুলো গোলা ছুঁড়তেই অশ্বারোহী সেনারা প্রবল উৎসাহে সামনে এগোল। তাদের ঘোড়াগুলো ছোটা শুরু করতেই পতাকাগুলো বাতাসে পত পত করে ভাসতে লাগলো। তাদেরকে অনুসরণ করলো পদাতিক বাহিনী, তাদের মধ্যে কিছু সৈন্য লম্বা মই বহন করছিল।
উমর আলি আবার আওরঙ্গজেবকে তাঁর গদিওয়ালা আসনে বসাতেই কাছেই পাহাড়ের মাটিতে একটি কামানের গোলা এসে পড়লো। আওঙ্গজেব আর তার হাতির গায়ে মাটি ছড়িয়ে পড়লো। প্রশিক্ষিত বজ্রদেবের কিছুই হল না, তবে পতকাবাহকদের একটি ঘোড়া আতঙ্কিত হয়ে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতেই এর আরোহীকে পিঠ থেকে প্রায় ফেলে দিচ্ছিল। ঘন ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে আওরঙ্গজেব দেখলেন দুর্গের দিকে অর্ধেক পথ যাওয়ার আগেই মারাঠিদের কামান আর গাদা বন্দুকের গোলার আঘাতে দুজন পতাকাবাহকসহ কয়েকজন অশ্বারোহীসেনা হাত-পা ছড়িয়ে মাটিতে পড়ে রয়েছে। আরো কয়েকজন আহত অশ্বারোহীসেনা পিছু হটছে। যদিও অন্যরা ইতোমধ্যেই দুর্গের দেয়ালের নিচে পৌঁছে গেছে, কয়েকজন ঘোড়ার পাদানিতে দাঁড়িয়ে একহাতে ঘোড়ার রাশ ধরে অন্য হাতে পিস্তল নিয়ে দুর্গের ছাদের উপর শত্রুপক্ষের সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে। এদের পেছনে যে বরকন্দাজ সেপাইরা ছিল, তারা মাটিতে শুয়ে গাদা বন্দুক নিশানা করছিল।
একটি আতঙ্কিত ঘোড়া হঠাৎ আরোহীসহ দুর্গের পেছনের পাহাড় চূড়ার উপর দিয়ে ছুটলো। পদাতিক সেনারা উপরে উঠার আগেই বারোজনেরও বেশি মোগল বরকন্দাজ হতাহত হল। ওদের মধ্যেও অনেকে হতাহত হয়েছিল। কয়েকজন স্থির হয়ে পাহাড়ের খাড়া ঢালে পড়েছিল আর অন্যরা হামাগুড়ি দিয়ে কিংবা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মোগল শিবিরের দিকে ফিরে আসছিল। তবে যারা দেয়ালের কাছে পৌঁছেছিল, তারা দ্রুত মই খাড়া করে দেয়ালে উঠতে শুরু করলো। দুর্গের ছাদে থাকা মারাঠিরা কয়েকটি মই ঠেলে ফেলে দিল। মইয়ের সাথে লেগে থাকা মোগল সেনারা পেছনে তাদের সহযোদ্ধাদের গায়ের উপর পড়লো। এদের সাথে সাথে দুই-তিনজন মারাঠি সেনাও মোগল গাদা বন্দুকের গুলিতে আহত হয়ে ছাদ থেকে নিচে পড়ে গেল।
তবে তিনি যেরকম আশা করেছিলেন, মোগল সেনারা যথেষ্ট মনোবল দেখাতে লাগলো। দ্রুত প্রচুর সেনা দেয়ালের কাছে পৌঁছতেই আরো অনেক মই লাগান হল। মই থেকে ওরা অনেকে ছাদে উঠতে সফল হল। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে ছাদের উপর উভয়পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি লড়াই চলছে। ধীরে ধীরে মারাঠিরা দেয়াল ধরে পিছু হটছে। প্রচুর হতাহত করা ছাড়াও মোগলরা ওদেরকে ছোট ছোট দলে একে অপরের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলছিল। ইতোমধ্যে ওরা মারাঠিদের বড় একটি কামান দখল করে কামানের মুখ পিছন দিকে ঘুরিয়ে দুর্গের দিকে গোলা ছোঁড়ার চেষ্টা করছিল। এর কাছেই একজন মোগল সেনা ছাদের একটি ছিদ্রের সাথে বিশাল একটি সোনালি-সবুজ মোগল পতাকার দণ্ড বেঁধে দিতেই পতাকাটি হাওয়ায় পতপত করে উড়তে লাগলো।
আওরঙ্গজেব বললেন, “আল্লাহর রহমতে যুদ্ধের গতি আমাদের অনুকূলে যাচ্ছে। গরমে আমার মাথা দপদপ করছে উমর আলি। চল আমরা বড় তাবুতে ফিরে যাই। ঐ ছাতাটা নাও। রোদ সহ্য হচ্ছে না।’
সেদিন সন্ধ্যায় হেরেম তাঁবুতে আওরঙ্গজেব একটি রেশমি বালিশে মাথা রেখে একটি ডিভানের উপর শুয়ে চোখ বুজে ছিলেন। উদিপুরী মহল তার দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বললেন, আপনাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অবশ্য আজ আপনি যা করেছেন, তাতে ক্লান্ত হবারই কথা।
তিনি বললেন, হ্যাঁ আমি ক্লান্ত। তবে আমার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। আমার উপস্থিতিতে আমার লোকেরা উজ্জীবিত হয়েছে। দুইঘণ্টারও কম সময়ে আমরা পুরো দুর্গ দখল করতে পেরেছি। যদিও কিছু সৈন্যসহ এর অধিনায়ক মাটির নিচের একটি গোপন পথ দিয়ে পালিয়ে গেছে। এবার আমি যগিনগড় দুর্গ সঠিকভাবে সুরক্ষিত করবো। মারাঠিরা আর এটা পুনর্দখল করতে পারবে না, আর নয়তো আমার সেনাপতিদের এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
‘আপনার সফলতায় আমি খুশি হয়েছি, তবে নিজের শরীরের উপর বেশি চাপ নেবেন না।’