আওরঙ্গজেব অপেক্ষা করছিলেন দেখার জন্য যে শিবাজি তার জন্য নির্ধারিত জায়গায় যান কি-না, কিন্তু তার বদলে মারাঠি নেতা সচিবের বাধা এড়িয়ে সামনে একেবারে মঞ্চের কিনারায় এসে বললেন, ‘জাহাপনা, আপনার মতো আমিও একজন শাসক। আমার শরীরে রাজরক্ত বইছে, অথচ আপনি আমাকে আমার চেয়ে নিচু স্তরের মানুষের সারিতে স্থান দিচ্ছেন। কেন আমাকে অপমান করছেন?
শিবাজি এত কাছে এসে পড়েছেন যে, আওরঙ্গজেব তার দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন আর তার চোখে আগুন দেখতে পাচ্ছিলেন। কামরায় নীরবতা আরো গাঢ় হয়ে এসেছিল। ধীরে ধীরে আওরঙ্গজেব উঠে দাঁড়ালেন। ইচ্ছে করেই কণ্ঠস্বর শান্ত রেখে বললেন, আপনি এক্ষুনি আমার আনুগত্য ঘোষণা করে শপথ বাক্য পাঠ করেছেন, অথচ তারপরও আমার কথা অমান্য করে প্রকাশ্যে আমার বিরোধিতা করছেন।
শিবাজি সাথে সাথে উত্তর দিলেন, আর আপনি সবার সামনে আমায় অবমাননা করছেন। আমি আর এখানে থেকে অপমান সহ্য করবো না। এই কথাটি বলেই সাথে সাথে পেছন দিকে ঘুরে শিবাজি তার ছেলের হাত ধরে টানতে টানতে সভাসদদের মধ্য দিয়ে পথ করে নিয়ে বাইরের দিকে চললেন। আওঙ্গজেব আদেশ দিলেন, ‘প্রহরী, ঐ লোকটিকে থামাও! তাকে আর তার ছেলেকে গ্রেফতার কর। ফাওলাদ খান, যে পর্যন্ত না আমি এদের ভাগ্য নির্ধারণ না করি, ততদিন আপনি আগ্রার সুবেদার হিসেবে এদেরকে আপনার হেফাজতে রাখবেন।
শিবাজি ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকালেন, তবে প্রহরীরা তাকে আর তার ছেলেকে দ্রুত বাইরে নিয়ে যেতেই তিনি বাধা দিলেন না। আওরঙ্গজেব আবার সিংহাসনে বসলেন। কেউ তার দিকে না তাকালেও অনুমান করতে পারছিলেন যে, ভেতরে ভেতরে তিনি রেগে ফেটে পড়ছিলেন। তিনি বললেন, ‘চলুন আমরা দরবারের কাজে ফিরে যাই–বাংলা থেকে খাজনা কিরকম আদায় হল…।’
*
শিবাজি বেশ সাবধানে তার কাঁধ সমান উঁচু বিশাল আকৃতির বেতের ঝুড়িগুলোর ভেতরের মালামাল পরীক্ষা করলেন–নানরুটি, বাক্সভরা শুকনো খুবানি আর কিসমিশ, চাউল আর ডালের ছোট ছোট থলে। তারপর মৃদু হাসলেন–যেরকম বলেছিলেন সবকিছু সেরকমই এসেছে।
শেষ ডালাটি বন্ধ করার পর তার নায়েব একুজি বললো, “মহারাজ, আগ্রার গরিব মানুষেরা রোজ আপনার নাম গান গায়। আমি প্রহরীদেরকে জিজ্ঞেস করবো তারা ঝুড়িগুলো পরীক্ষা করবে কি-না। তারপর বেহারাদেরকে ঝুড়িগুলো গাড়িতে তুলতে বলবো।
‘খুব ভাল। প্রহরী আর বেহারাদেরকে রোজকার মতো পাওনা মিটিয়ে দিতে ভুলো না। আমি নিশ্চিত হতে চাই যেন খাবারগুলো যাদের জন্য পাঠানো হচ্ছে। তাদের কাছে ঠিকমতো পৌঁছুক। শুনেছি বাজারে রুটির দাম খুব বেড়ে গেছে আর আমাদের সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ অনাহারে রয়েছে। শিবাজি এর বেশি বললেন না। আওরঙ্গজেবের চোখ আর কান রয়েছে সবজায়গায় আর সেজন্যই তিনি বেশ সাবধানে কথা বলেন।
গত তিনমাস ধরে ওদেরকে দুর্গের সংকীর্ণ যে ঘরে আবদ্ধ রাখা হয়েছিল সেখান থেকে প্রতিদিন বিকেলে তিনি একুজিকে দুর্গের বাজারে পাঠিয়ে আসছেন। তার নায়েবের সেখানে যাওয়ার অনুমতি ছিল। সেখান থেকে সে আগ্রার গরিব মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেবার জন্য খাবার কিনতে যেত। শুকনো খাবার ভর্তি তিনটি ঝুড়ি শিবাজি শহরের একটি মন্দিরে পাঠাতেন। প্রথম প্রথম প্রহরীরা এই দানকর্ম করার অনুমতি দিতে রাজি ছিল না, ওরা সুবেদার ফাওলাদ খানের কাছ থেকে অনুমতি আনার কথা বলেছিল। সুবেদারও সন্দেহ করেছিলেন, প্রথম কয়েকদিন খাবার ভর্তি ঝুড়ির ভেতরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখলেন আর ফেরার সময় আবার পরীক্ষা করলেন যে, ভেতরে কেউ শিবাজির জন্য কোনো অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে কি-না। তবে শিবাজি যেরকম আশা করেছিলেন, রোজ রোজ একই রকম পরীক্ষা করতে করতে সুবেদার বিরক্ত হয়ে গেলেন। তিনি সন্তুষ্ট হয়ে এই কাজের ভার প্রহরীদের উপরেই ছেড়ে দিলেন। আর শিবাজির কাছ থেকে প্রতিদিন রূপার মুদ্রা পেয়ে ওরা খুশি মনেই এই কাজটি করে চললো।
এখন ওরাও ওদের দায়িত্বে শিথিল হতে শুরু করেছে। বেশিরভাগ সময় ওরা পেটমোটা বেতের ঝুড়িগুলোর ভেতরে একবার উঁকি মেরেই ছেড়ে দিত। ছোট একটি উঠানের চতুর্দিকে চারটি কামরা নিয়ে শিবাজির কারাগার। এখান থেকে বের হবার যে ফটক রয়েছে তার বাইরে একটি গাধার গাড়িতে ঝুড়িগুলো তোলা হল। মাল তোলার পর হলুদ পাগড়িপরা গড়োয়ান লাগামটি একবার ঝাঁকি দিতেই গাধার গাড়িটি দুর্গের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে চললো। গেট পার হয়ে শহরের রাস্তা ধরে মন্দিরের দিকে চলতে শুরু করলো। খাবারগুলো সেখানে বিতরণ করা হবে। শিবাজি নিজেকে বাহবা দিলেন, প্রহরীগুলো কি বোকা। শুকনো ফলের ভেতরে লুকিয়ে রেখে মন্দিরের পুরোহিতের কাছে তিনি যে লিখিত বার্তাটি পাঠিয়েছেন, তা ওরা দেখতে পায় নি। আর পুরোহিত যে উত্তরটি পাঠিয়েছিলেন তাও ওরা দেখে নি। চিঠির উত্তর লেখা ছোট কাগজটি পেঁচিয়ে বেতের ঝুড়ির বেতের ফাঁকে গুঁজে রাখা ছিল। শিবাজি যা জানতে চেয়েছিলেন, তার উত্তরে ওরা লিখে জানিয়েছিল, ওরা তার কয়েকজন সেনাপতির সাথে যোগাযোগ করেছিল আর তাদেরকে বলেছিল ওরা যেন দ্রুতগামী দুটি ঘোড়া নিয়ে শহরের বাইরে নির্দিষ্ট স্থানে তৈরি হয়ে থাকে। শিবাজির পালিয়ে বের হওয়া পর্যন্ত ওরা তার জন্য অপেক্ষা করবে।