আমার আশংকা আমার ক্ষয়িষ্ণু স্বাস্থ্য আমাকে আর লিখতে অনুমতি দেবে না। যদি ঈশ্বর আমার আয়ু বাড়িয়ে দেন তবে আবার আমি কাজ শুরু করবো। আর যদি তা না হয়, তবে আমি স্যর উইলিয়াম নরিস, আপনার অনুগত প্রজা এবং হিন্দুস্তানের রাষ্ট্রদূত, মহামান্যের প্রতি অভিবাদন জানাচ্ছি আর আমার স্ত্রীকে আপনার করুণায় ছেড়ে দিলাম।
২১. হিন্দুস্তান আমাদের দেশ!
‘উমর আলি আমার যুদ্ধের হাতি আনতে বল। আমি যুদ্ধ সীমান্ত অগ্রে গিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করবো। আমাকে দেখে সৈন্যদের মনোবল বেড়ে যাবে। যগিনগড়ের মতো এই দুর্গটির এত বড় একটি সেনাবাহিনীকে এতদিন থামিয়ে রাখার কথা নয়। আমি বোরহানপুর থেকে আসার আগেই আমার সেনাপতিদের এটা দখল করা উচিত ছিল।’
উমর আলি উত্তর দিল, জাঁহাপনা, আপনার প্রয়োজন পড়লে আমি অবশ্যই আপনার যুদ্ধহস্তী নিয়ে আসার নির্দেশ দেব। তবে আপনি যদি অনুমতি দেন। তো বলি, জাঁহাপনা, এখানে আসার মাত্র কিছুদিন হয়েছে, আপনি কী যথেষ্ট শক্তিশালী বোধ করছেন? আর জাঁহাপনা, যদি আপনি সম্মুখ সারি থেকে যুদ্ধ শুরু করার ইঙ্গিত দিতে চান, তা কী হাতির পিঠে বসে করতে হবে? হাওদায় বসলে আপনি মারাঠি গোলন্দাজ সেনা আর বরকন্দাজদের সহজ লক্ষ্যবস্তু হবেন। পালকিতে বসাই বরং অনেক আরামদায়ক আর কম বিপজ্জনক হবে।’
‘তুমি আমার জন্য উদ্বিগ্ন হয়েছ, তা আমি বুঝতে পেরেছি। তবে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি, আমি এখনও এই কাজ করতে যথেষ্ট শক্তি রাখি। আমি যুদ্ধহস্তী ব্যবহার করবো। যদিও এতে আমি স্বভাবতই একটি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হব, তবে সেই সাথে আমার সৈন্যরা আমাকে দেখতে পাবে আর সেটাই আমার উদ্দেশ্য।
আধাঘণ্টা পর সবুজ রঙের মোগল যুদ্ধবেশ পরে আওরঙ্গজেব তার সোনা বাঁধান হাতের লাঠিটা তাঁর পাশে দাঁড়ান তরুণ কোরচির হাতে দিয়ে তার সাহায্য নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চে উঠতে শুরু করলেন। এই মঞ্চ থেকে তিনি তাঁর যুদ্ধের হাতির পিঠে চড়বেন। বিশাল প্রাণীটির নাম বজ্রদেব। এই পুরুষ হাতিটি তার অত্যন্ত প্রিয়। হাতিটি শান্তভাবে মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়েছিল। দুই মাহুত হাতিটির কানের পেছনে বসেছিল। হাতির দাঁতের হাতলের একটি ছয়ফুট লম্বা গাদা বন্দুক হাতে নিয়ে উমর আলি সবুজ মখমলের গদিওয়ালা রাজকীয় আসনের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার দাড়ি এখন সাদা হয়ে এসেছে। অনেক সৈন্য যেন তাঁকে দেখতে পারে এজন্য আওরঙ্গজেব হাওদার ছাদ সরিয়ে দিতে বলেছেন। হাতির ঠিক পেছন পেছন যে দেহরক্ষী ঘোড়ায় চড়ে আসবে সে একটি বড় ছাতা বহন করবে। ফেরার সময় প্রয়োজন বোধে রোদের তাপ থেকে সম্রাটকে রক্ষা করার জন্য সে ছাতাটি উমর আলির হাতে দেবে।
আওরঙ্গজেব ধীরে ধীরে মঞ্চের উপর চড়লেন, তারপর উমর আলির সাহায্য নিয়ে হাতির পিঠে চড়ে হাওদায় বসলেন। মাহুতের নির্দেশে বজ্রদেব ধীরে সুস্থে গজেন্দ্রগমনে চলতে শুরু করলো, তার হাঁটার এই ভঙ্গির সাথে আওরঙ্গজেব বেশ পরিচিত ছিলেন। একটু পরই তিনি কামানের পেছনের সারির কাছে এসে থামলেন, তারপর গোলন্দাজ সেনাদেরকে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করলেন। তারপর তিনি অশ্বারোহী, বরকন্দাজ আর পদাতিক সৈন্য সারির কাছে পৌঁছলেন, সকলেই তখন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছিল। মাহুত তার ইস্পাতের আংকা দিয়ে খোঁচা দিয়ে ব্রজদেবকে সারিবদ্ধভবে দাঁড়িয়ে থাকা সৈন্যদের মধ্য দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে চললো। আওরঙ্গজেব হাত তুলে সৈন্যদের সম্ভাষণ জানাতেই সৈন্যরা ‘আওরঙ্গজেব জিন্দাবাদ! আওরঙ্গজেব দীর্ঘজীবী হোন!’ বলে চিৎকার করে উঠলো।
কয়েকমিনিট পর তিনি একদল জ্যেষ্ঠ সেনানায়কের সামনে এলেন, তাঁর অনুরোধে তারা এখানে তাঁকে স্বাগত জানাতে সমবেত হয়েছিল। বজ্রদেব তাদের সামনে এসে থামলো, তারপর উমর আলির সাহায্য নিয়ে আওরঙ্গজেব আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্রধান দেহরক্ষীর হাত ছেড়ে দিয়ে সেনানায়কদের মুখোমুখি হলেন। কয়েকজন তার চোখের দিকে তাকাতে পারলো না। অন্যরা এক পা থেকে অন্য পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল। পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে ওরা অস্বস্তিতে রয়েছে। তিনি ভাবলেন, হওয়ারই কথা, অবরোধ করতে গিয়ে ইতোপূর্বে তারা যে অবস্থার সৃষ্টি করেছে, তাতে এরকমই হওয়ার কথা। তিনি পরিষ্কার জোরালো কণ্ঠ বলতে শুরু করলেন, আমি আজ আশা করবো তোমরা পূর্ণ শক্তি ও মনে সাহস, আমাদের উদ্দেশ্য আর আমাদের অস্ত্রের উপর সম্পূর্ণ আস্থা নিয়ে দুর্গ আক্রমণ করবে। এযাবৎ এই মারাঠিদের তোমরা হেলাফেলা করেছ। এখন ওদের দেখিয়ে দাও কে শ্রেষ্ঠ আর আমার কাছে তোমাদের সত্যিকার যোগ্যতা প্রমাণ কর। আজই এই দুর্গ দখল কর!
একে একে তারপর একযোগে সেনানায়করা চিৎকার করে তার প্রতি সমর্থন ঘোষণা করলো। আওরঙ্গজেব এক হাত তুলে তাদেরকে চুপ করার নির্দেশ দিলেন। তারপর বললেন, এখন তোমাদের কাজ হল যার যার পল্টনের কাছে গিয়ে তোমাদের সৈন্যদেরকে নতুন উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে উৎসাহিত করা, যেরকম এখন চিৎকার করে আমাকে সমর্থন করে দেখিয়েছ। আধাঘণ্টার মধ্যে সৈন্যদের সামনে আমি আমার গাদা বন্দুক থেকে একবার গুলি ছুঁড়ে আক্রমণ শুরু করার ইঙ্গিত দেব।’