এই অর্থলোলুপ লোকগুলোর সাথে বহুবার আলোচনায় বসলাম। প্রায় সকলেই আমার কাছ থেকে বন্ধুত্ব এবং সুভেচ্ছার নিদর্শন কামনা করলো পরিষ্কারভাবে বলা যায় ঘুষ চাইল। সম্রাটের নিষেধ সত্ত্বেও অনেকেই মদের প্রতি বিশেষত ‘উত্তর ব্রিটিশ মদ’এর প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখাল। তারপর অনেক সময় আর অর্থব্যয়ের পর আমি তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু সুবিধা আদায় করলাম, যেমন কর এবং শুল্কের পরিমাণ কমান হল এবং আমাদের বণিক এবং মালামালের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি আদায় করলাম। তবে আমার কোনো সন্দেহ নেই যে, পরবর্তী প্রতিশ্রুতিটি কার্যক্ষেত্রে ঘুষ ছাড়া বাস্তবায়িত হবে না।
মোটামুটি গত ছয়মাসের আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, মোগল সাম্রাজ্য এর অভ্যন্তরীণ শত্রুর কারণে দৃঢ়তা হারিয়ে ফেলছে। সবার আগে শক্তিশালী মারাঠিদের কথা বলতে হয়, তাদের শাসক সম্ভাজির মৃত্যুর পরও তারা টিকে থাকতে পেরেছে। তারপর একসময় যখন তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছিল, তখন আবার শিবাজির ছোট ছেলে এবং সম্ভাজির ভাই-রাজারামের নেতৃত্বে সংগঠিত হল। এরা অবিরত সম্রাট এবং তার সেনাবাহিনীর প্রতি একটি ভীতি হয়ে রইল এবং বিশেষত দাক্ষিণাত্যে ওদেরকে আটকে রাখলো। আমি দেশ ছাড়ার আগে জানতে পেরেছি যে রাজারাম মারা গেছে, তবে তার বিধবা স্ত্রী কোনো রক্তপাত ছাড়াই তাদের নাবালক ছেলেকে তার উত্তরাধিকার নিযুক্ত করতে সফল হয়েছেন।
আরো অনেক বিদ্রোহ রয়েছে বিভিন্ন জায়গায়–উত্তরে, উদাহরণস্বরূপ, পাঞ্জাবের শিখ আর জাটরা। আমি শুনেছি শিখদের একটি আলাদা ধর্মবিশ্বাস রয়েছে, তারা এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করে। আওরঙ্গজেব তাদের নেতা_যাকে তারা তাদের গুরু বলেন,–সেই তেগ বাহাদুরকে ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে কোতল করার পর, শিখরা তেগ বাহাদুরের ছেলে গুরু গোবিন্দ সিং-এর নেতৃত্বে তাদের নিজেদের বন্ধন সুদৃঢ় করে। গুরু গোবিন্দ ইতোপূর্বে মোগল এবং অন্যান্য প্রতিবেশী শক্তির সাথে বেশ কয়েকবার যুদ্ধ করেছিলেন। আমি যখন হিন্দুস্তান ছিলাম, তখন ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসের বাৎসরিক ফসল কাটার দিন, আনাদপুরে শিখদের একটি বিশাল সমাবেশের খবর শুনে মোগল সেনাপতিদের মধ্যে আতঙ্ক জেগে উঠেছিল। তাদের গুরু গোবিন্দ খালসা নামে শিখদের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এখন থেকে সকল সদস্য তাদের নামের সাথে সিং’ অর্থাৎ সিংহ যুক্ত করবেন, আধ্যাত্মিক ঐক্য বজায় রাখবেন এবং তাদের নিজেদেরকে এবং ধর্মকে যারা দমিয়ে রাখার চেষ্টা করবে তাদেরকে প্রতিরোধ করবে। আমি যখন হিন্দুস্তান ছেড়ে আসি তখন মোগলরা শিখদের বিরুদ্ধে একটি বিশাল যুদ্ধাভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
জাটরাও সাহসী যোদ্ধা। ওরা অতর্কিত হামলা করে পালিয়ে যেতে পারঙ্গম। সম্প্রতি ওরা আগ্রার কাছে সম্রাট আকবরের জাঁকজমকপূর্ণ বিশাল সমাধিসৌধে হামলা চালিয়ে এর বেশিরভাগ সোনার সাজসজ্জা আর আসবাব লুট করে নিয়ে যায়। সাম্রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে পারস্যের শাহ সবসময় একটি আতঙ্ক ছিল। নিজের সাম্রাজ্যের পরিধি বাড়াবার জন্য তিনি সবসময় মোগল সাম্রাজ্যের দিকে হাত বাড়াবার সুযোগ খুঁজতেন।
বিদ্রোহী এবং বহিঃশত্রুর হামলার আশংকা ছাড়াও আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্য আরো অন্যদিক থেকে চাপের মুখে ছিল। দূরবর্তী প্রদেশগুলোর দুর্নীতিপরায়ণ রাজকর্মকর্তারা মনে করতো সম্রাট মারাঠিদের নিয়ে ব্যস্ত আছেন, কাজেই সেই সুযোগে ওরা হিন্দুস্তানের দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে অর্থ আদায় করতো। অবিরত যুদ্ধ চলার কারণে মোগল সাম্রাজ্যের কোষাগারের উপর চাপ পড়ায় সম্রাট কর বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হন, যার ফলে প্রজাদের দুর্দশা আরো বেড়ে যায়।
আমার মতে সম্রাট তার শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব দিয়ে একা তার সাম্রাজ্যকে ধরে রেখেছেন। তাঁকে যেমন সবাই ভয় পায় তেমনি সম্মানও করে। তার বয়স হওয়া সত্ত্বেও কেউ তাঁর বুদ্ধির সূক্ষ্মতা আর অন্যদের মনের ভেতরে ঢুকে গিয়ে তাদের কার্যকলাপ আগে থেকে বুঝে নেওয়ার ক্ষমতার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ প্রকাশ করে না। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রয়োজনে তিনি সবচেয়ে কাছের পরিচারক আর দেহরক্ষীদের বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য বিশেষ যত্নবান থাকেন। আর অনেক সময় সাধারণ মানুষদের প্রতিও ছোটখাট দয়া-দাক্ষিণ্য আর তাদের প্রতি মনোযোগ দেখিয়ে তাদের আস্থা অর্জন করেন। আবার তাদের প্রতি তাঁর আগ্রহ আর তাদের জীবন সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান দেখিয়ে তিনি তাদেরকে অবাক করে দিতেন।
আমি দেখতে পাচ্ছি, যখন তিনি মারা যাবেন তখন আবার সিংহাসনের দখল নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মাঝে একটি সংঘর্ষ শুরু হবে। তাঁর জীবিত চার ছেলের মধ্যে কে তাঁর উত্তরাধিকার হতে পারবে তা আমি বলতে পারবো না। এর আগে আমি বর্ণনা করেছি শাহজাদা মুয়াজ্জমকে বাইরে থেকে একজন সাধারণ মানুষ মনে হয়েছে। আকবর এখনও পারস্যে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন এবং আমি জেনেছি তাকে আতিথ্য দেওয়া হয়েছে তবে তার মায়ের তরফের আত্মীয় কিংবা শাহের তরফ থেকে কোনো ধরনের সামরিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি। তাছাড়া তার উপর শাহের তেমন আস্থাও নেই। আকবরের আপন ভাই আজম বর্তমানে গুজরাটের সুবেদার। সাধারণত সবাই জানে তিনি ঝোঁকের বশে চলেন এবং অত্যন্ত অপরিণামদর্শী, তার দ্বারা কোনো সফল অভিযান সম্ভব নয়। সবার ছোট কমবখসের একমাত্র যোগ্যতা হচ্ছে, তাকে তাঁর বাবার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র মনে করা হয় আর সেজন্য তার পথটি হয়তো সহজ। তবে তার সাথে মেশার পর তাকে আমার অর্বাচীন আর অলস মনে হয়েছে, যদিও তার মধ্যে যথেষ্ট রসবোধ আছে। হয়তো এমনও হতে পারে, আওরঙ্গজেবের শক্তিশালী সেনাপতিদের মধ্যে কেউ তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে নিজেই সিংহাসন দখল করতে পারে। তবে যাই হোক, এই অবশ্যসম্ভাবী বিভ্রান্তি আর অন্তঃকলহ আমাদের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করবে। সেদেশের সাথে আমাদের বাণিজ্য থেকে বর্ধিতহারে যে লাভ হচ্ছে, তা কাজে লাগিয়ে সুবিধাজনক এলাকার গভর্নরদের ঘুষ দিয়ে হাত করে এই সম্পদশালী আর বিশাল দেশে ইংল্যান্ডের অবস্থান আরো সুপ্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে। যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার ভাঙ্গনের মুখে রয়েছে।