জাহানারা মৃদু হাসলেন, যে হাসির কথা আওরঙ্গজেবের ভালো মনে আছে। তিনি বললেন, উপাধি কিংবা বিলাসিতা নয়, সবচেয়ে ভালো হয় যদি তুমি কথা দাও যে, সাম্রাজ্যের মঙ্গল করবে আর পরিবারের বাকি আমরা যারা আছি তাদের দিকে খেয়াল রাখবে। হে আল্লাহ, এটাই হবে আমাদের বংশের নতুন সূচনা।
০৩. বন্দী
আগ্রা দুর্গের দেওয়ান-ই-আম-এর মঞ্চের উপর আওরঙ্গজেব একটি সোনালি চেয়ারে খুশিমনে বসলেন। একপাশে দেয়ালের উঁচু জায়গা থেকে জাফরির আড়াল থেকে জাহানারা তাকিয়ে রয়েছেন। বোনের সাথে মিটমাট করে ফেলার পর গত তিনটি মাস কেবল ভাল খবরই পাওয়া যাচ্ছিল আর এখন জাহানারা এবং পুরো সভাসদ আওরঙ্গজেবের সর্বশেষ বিজয় দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন। যে শিবাজি সুরাট বন্দর তছনছ করার সাহস দেখিয়েছিল, ১৫০,০০০ সেনার বিশাল একটি বাহিনী এবং উন্নততর কৌশল দিয়ে তাকে পরাভূত করা হয়েছে। তিনি বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। মারাঠি নেতা তেইশটি দুর্গ ফেরত দেওয়াসহ ৪০০,০০০ রুপি ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, একটু পরই তার বালক পুত্র সম্ভাজিকে নিয়ে দরবারে এসে আওরঙ্গজেবের সামনে নতজানু হবেন।
শিঙ্গা বেজে উঠতেই আওরঙ্গজেব বুঝলেন, শেষ পর্যন্ত সেই মুহূর্তটি এসে গেছে, এবার এই মরুভূমির ইঁদুরজোড়া আসল মোগল জাকজমক টের পাবে। তিনি ওদেরকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে রোজকার প্রথামাফিক একের পর এক রাজকীয় ডিক্রি জারি করতে শুরু করলেন এবং আর্জিদারদের বিরাট একটি সারির অভিযোগ ইত্যাদি সমাধান করতে লাগলেন। পার্থিব জগতের প্রতীক জাঁকালো পোশাক-অলঙ্কার ইত্যাদি ব্যবহারকে তিনি সাধারণত অসার দম্ভের প্ররোচনা এবং ধর্মদ্রোহিতাপূর্ণ অহংকার হিসেবে ঘৃণা করেন। তবে অনেক সময় এগুলো কাজে লাগে আর এখন সেই সময়টি এসেছে। অত্যন্ত যত্নসহকারে সোনালি এমব্রয়ডারি করা দুধ-সাদা ব্রোকেডের আলখাল্লা পরেছেন। আলখাল্লাটির গলায় আর হাতে মুক্তার মালা সেলাই করা, খোদাই করা পান্না আর রক্তলাল রুবির মালা গলায় পেঁচিয়েছেন। হীরকখচিত কোমরবন্ধ থেকে আলমগির তরোয়ালটি ঝুলছে। বিখ্যাত এই তরোয়ালটি তার পূর্বপুরুষ বাবর, ফারগানা থেকে এনেছিলেন আর আঙুলে ঝলমল করছে তৈমুরের সোনার বাঘের মাথাওয়ালা একটি আংটি। তিনি মনে মনে তাঁর নিজের প্রতিচ্ছবিটি এভাবে আঁকলেন : ছেচল্লিশ বছর বয়সে জাগতিক সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী পূর্ণতাপ্রাপ্ত সম্রাট আওরঙ্গজেব। ষষ্ঠতম এবং আল্লাহর মেহেরবাণিতে হয়তো সমগ্র মোগলদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট। এই ভাবমূর্তিটি তাঁকে পরিতৃপ্ত করলো।
দুপাশে ছয়জন করে মোগল দেহরক্ষীদল শিবাজি আর তার পুত্রকে ঘিরে সভাসদদের সারির মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে এল। দেহরক্ষীদের পরনে সবুজ পোশাক, বুকে চকচকে পালিশ করা বর্ম আর হাতে লম্বা বর্শা। সবাই ঘুরে উৎসুক দৃষ্টিতে দাক্ষিণাত্যের নেতার দিকে তাকাল। আওরঙ্গজেবের চেয়ে মারাঠি নেতা অন্তত ছয় ইঞ্চি বেঁটে আর হালকা-পাতলা গড়নের। শিবাজি মঞ্চের সামনে এসে থামলেন, তার ছেলে কয়েক পা পেছনে দাঁড়াল। একজন পরাভূত শত্রু হিসেবে বিনয়ের সাথে মাটির দিকে চোখ না রেখে তিনি অপলকভাবে সরাসরি সম্রাটের মুখের দিকে তাকালেন। সাথে সাথে আওরঙ্গজেব তাচ্ছিল্যের সাথে মাথা ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালেন। আরেকবার তূর্যধ্বনি হল, আওরঙ্গজেবের সচিব সামনে এগিয়ে শিবাজির সামনে একটি কাগজ মেলে ধরলো। তিনি এখন যে আনুগত্যের শপথ নেবেন, সেই বাক্যগুলো এতে লেখা ছিল।
শিবাজি আর তার দিকে তাকিয়ে নেই, এটা বুঝতে পেরে আওরঙ্গজেব আবার মঞ্চের উপর থেকে নিচের দিকে তাকালেন। বাক্যগুলো জোরে জোরে না পড়ে তিনি ভ্রু কুঁচকিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেগুলো পরীক্ষা করছিলেন। তারপর তিনি ঘুরে সচিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শব্দগুলো ফারসিতে লেখা হয়েছে– ভাষাটি আমি ভালই জানি, আপনি শুনতেই পাচ্ছেন, তবে আমি আমার দেশীয় ভাষায় শপথ নিতে চাই।’
আওরঙ্গজেবের দেহ কঠিন হয়ে গেল। পরাজিত হয়েও কি লোকটার শিক্ষা হয় নি? তিনি বললেন, আপনি আমার দরবারের ভাষা–ফারসিতে শপথ নেবেন।
শিবাজি বললেন, ঠিক আছে। তারপর তিনি গম্ভীর কণ্ঠে সাবলিলভাবে ফারসিতে শপথবাক্য পাঠ করা শুরু করলেন, আমি শিবাজি, মারাঠি গোষ্ঠীর নেতা এই মর্মে সম্রাট আরঙ্গজেবের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করছি, যাকে আমি আমার অধিরাজ স্বীকার করছি এবং বিশ্বস্ততা এবং সম্মানের সাথে তার সেবা করবো। একই সাথে আমার পুত্র সম্ভাজিও এই শপথ বাক্য মেনে চলবেন।
আওরঙ্গজেব শুনেছিলেন যে, শিবাজি নিজেকে একজন শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে দাবি করতেন। শপথবাক্য পাঠ করার পর আওরঙ্গজেব একবার মাথা নেড়ে তাঁর স্বীকৃতি জানালেন, তারপর দরবারে নীরবতা নেমে এল। মারাঠি লোকটিকে বুঝতে হবে যে, মোগল সাম্রাজ্যে সে কতটা গুরুত্বহীন। আর এই পূর্ণ দরবার ছাড়া আর কোথায় সেটা ভালো হয় দেখান, যেখানে হাজির রয়েছে ঐ কমলা রঙ-এর পোশাকপরা রাজপুতদের মতো অন্যান্য সামন্তরাজা, যাদেরকে তিনি আগ্রায় ডেকে এনেছিলেন। অবশ্য মাঝে মাঝে ঐ রাজপুত রাজাদের অহঙ্কারও তার কাছে অসহ্য মনে হত।
তিনি দরবারের সচিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার এই সর্বশেষ সামন্ত রাজাকে ঐ সেনাপতিদের পেছনে নিয়ে যাও, যাতে তিনি লক্ষ করতে পারেন কিভাবে আমরা দরবারের কাজ চালাই আর সেখান থেকে তিনি শিখতে পারেন। শিবাজি ঘুরে দেখলেন, আওরঙ্গজেব দরবার কক্ষের একেবারে পেছন দিকে দেখাচ্ছিলেন, যেখানে সর্বকনিষ্ঠ কর্মকতারা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এটা দেখে অপমানে তার মুখ লাল হয়ে গেল। আওরঙ্গজেবের সামনে যারা উপস্থিত ছিল তারা সবাই শাসরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। তিনি বুঝতে পারলেন ওরা ভালোভাবেই তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে যে, তিনি এই হঠাৎ গজিয়ে উঠা পরাভূত শত্রুর দর্পচূর্ণ করতে চলেছেন। অন্য কোনো অদূরদর্শী মানুষ হলে তাকে ফাঁসি দিয়ে দিত, অথচ তিনি তার সাথে কত মহানুভবতাই না দেখিয়েছেন। একজন বীর শহিদ হলে ভবিষ্যতে তার জাতিকে বিদ্রোহে অনুপ্রেরণা যোগাতো, অথচ তার বদলে চোখের সামনে নতজানু হয়ে থাকা একজন অধীনস্ত সামন্ত রাজা নিশ্চয়ই অনেক ভাল।