- বইয়ের নামঃ এস্পায়ার অব দ্য মোগল ট্রেইটরস ইন দ্য শ্যাডোস
- লেখকের নামঃ অ্যালেক্স রাদারফোর্ড
- প্রকাশনাঃ রোদেলা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
এস্পায়ার অব দ্য মোগল ট্রেইটরস ইন দ্য শ্যাডোস
০১. বাঘ-নখ
ট্রেইটরস ইন দ্য শ্যাডোস : এম্পায়ার অব দ্য মোগল (৬) / মূল : অ্যালেক্স রাদারফোর্ড / ভাষান্তর : কাজী আখতারউদ্দিন
শাসন করার কাজটি এতই সূক্ষ্ম যে, একজন রাজাকে তাঁর নিজ ছায়ার প্রতিও ঈর্ষান্বিত হতে হয়।
-সম্রাট আওরঙ্গজেব
০১. বাঘ-নখ
একটি সমর সভায় যোগ দিতে দাক্ষিণাত্যের পাহাড়ি পথ দিয়ে পাশাপাশি ঘোড়ায় চড়ে যেতে যেতে দাড়িওয়ালা মারাঠা সেনানায়ক তার সঙ্গীর সাথে কথা বলছিল–বিখ্যাত বিজাপুরী সেনাপতি আফজাল খান শিবাজীকে সাময়িক অস্ত্রবিরতির আহবান জানিয়েছিলেন, যাতে ওরা পরস্পর সাক্ষাৎ করে যুদ্ধ থামাবার শর্ত নিয়ে বিজাপুরীদের সাথে একমত হতে পারেন। শিবাজী সাময়িক অস্ত্রবিরতি এবং দেখা করার বিষয়ে রাজি হলেন। তবে আফজাল খানকে তার বিশ্বাস নেই, তাই সতর্কতার সঙ্গে প্রস্তুতি নিলেন। তিনি পাহাড়ের উপরে অবস্থিত তার দুর্গের নিচে ঘন জঙ্গলের মাঝে গাছ কেটে পরিষ্কার করে একটি খোলা জায়গায় সাক্ষাতের স্থান নির্ধারণ করলেন। আফজাল খানের অহমিকার কথা ভেবে তিনি এই স্থানটির ঠিক মাঝখানে রেশমি পর্দা ঝুলানো একটি জমকালো তাঁবু খাড়া করলেন। তারপর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ফাঁকা স্থানটি পর্যন্ত দুটি পথ তৈরি করলেন। একটি তার নিজের দুর্গের দিক থেকে, অপরটি আফজাল খানের শিবিরের দিক থেকে। তিনি তার শত্রুকে চিঠি লিখে জানালেন–এরকম একটি জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশ এমন দুইজন বিখ্যাত নেতার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাতের জন্যই অপেক্ষা করছে। তিনি আফজাল খানকে প্রথমে এসে এই চমৎকার পরিবেশ উপভোগ করতে আহ্বান জানালেন। তার এসব করার উদ্দেশ্য, যাতে তিনি জানতে পারেন আফজাল খান কোন পথ দিয়ে আসেন এবং নিজে আসার আগে পাহাড়ের উপরের দুর্গ থেকে পরিষ্কারভাবে শত্রুর আগমন লক্ষ করতে পারেন।
এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে তিনি পঞ্চাশজন পদাতিক সৈন্য পাঠিয়ে খোলা জায়গাটির চারদিকে ঘন জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে বললেন। আমি আমার লোকজনসহ তাদের মধ্যে ছিলাম। অস্ত্রসহ ভালোভাবে লুকোবার জন্য তিনি আমাদেরকে পাতাসহ গাছের ডালপালা শরীরে বাঁধার নির্দেশ দিলেন। সাক্ষাৎকারের নির্দিষ্ট সময় ঘনিয়ে আসতেই, শিবাজি তার দুর্গের উঁচু প্রাকার বেষ্টিত ছাদ থেকে দেখতে পেলেন–আফজাল খান প্রায় একশো লোক নিয়ে আসছেন। সাথে সাথে তিনি গোপিনাথ ব্রাহ্মণ নামক দূতকে পাঠালেন। আফজাল খানকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হল যে, তারা উভয়েই শুধু একজন সশস্ত্র দেহরক্ষী সাথে নিয়ে আসার বিষয়ে সম্মত হয়েছিলেন। তাই তাকে প্রস্তাব দেওয়া হল বাকি সেনাদেরকে এক মাইল দূরে একটি টিলার কাছে থামাতে। এই স্থানটি আগেই দৈবাৎ লাল ক্রস চিহ্ন দিয়ে রেখেছিলেন।
যথাসময়ে বিজাপুরী সেনাপতি টিলার কাছে তার লোকজনদের ছেড়ে বাকি পথটুকু কেবল একজন দেহরক্ষীসহ পালকিতে চড়ে তাবুতে পৌঁছলেন। আমি আমার লোকজনসহ পথের কাছেই লম্বা ঘাসের জঙ্গলের মাঝে লুকিয়ে ছিলাম। সবাই স্থির থাকতে চেষ্টা করছিলাম, তবে একটা কথা কি জান, ব্যাপারটা এতো সহজও ছিল না। একে তো গরম তার উপর চারদিকে মশা-মাছি ভন ভন করছিল। আমাদের উপর নির্দেশ ছিল, আফজাল খান কোনো চালাকি করার চেষ্টা করলে আমরা বের হয়ে আসবো। সোনার কাজকরা চার বেহারার পালকিতে চড়ে তিনি আমাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম, তার দেহে কোনো বর্ম নেই। কেবল একটি দুধসাদা ঢোলা আলখাল্লা পরে রয়েছেন, কোমরে রত্নখচিত কোমরবন্ধ বাঁধা। তাকে অনুসরণ করা মাথা কামানো বলিষ্ঠ দেহরক্ষীকে আমি চিনতে পারলাম। চেনার ভাল কারণ, সে ছিল সাঈদ বান্দা। তোমার ওখান থেকে আমার নাকের উপর যে কাটা দাগটা দেখতে পাচ্ছো, সেটা এই মাথা কামানো দানবটির তরোয়ালের আঘাতের ফলে হয়েছে। আমি যেখানে লুকিয়ে ছিলাম সেখান থেকে প্রায় একশো গজ দূরে ছোট দলটি তাবুর কাছে পৌঁছাবার পর বেহারারা পালকি নিচে নামিয়ে একটু পিছিয়ে মাটিতে আসন পেতে বসলো। আফজাল খান তার দেহরক্ষী সাঈদ বান্দাকে তাবুতে ঢুকতে ইশারা করলেন। সে ভেতরে ঢুকে এক মুহূর্ত পরেই বেরিয়ে এল। আপাতত সবকিছু ঠিকঠাক আছে দেখে সন্তুষ্ট হয়ে আফজাল খানকে ইশারা করলো। আফজাল খান পালকি থেকে বেরিয়ে তাঁবুতে ঢুকলেন।
এরপরই আমি পাহাড়ের উপরে দুর্গ থেকে তুর্যধ্বনির শব্দ শুনতে পেলাম। কয়েক মিনিট পর শিবাজি পায়ে হেঁটে এগিয়ে এলেন। তিনিও নীল সুতির সাধারণ একটি পোশাক পরে ছিলেন। আফজাল খানের মতো তিনিও একজন মাত্র দেহরক্ষী সাথে নিয়ে এসেছেন। শিবাজি তাঁবু থেকে কয়েক পা থাকতেই আফজাল খান দরজার কাছে হাজির হলেন। ওরা একটি বেমানান জুটি ছিল আফজাল খান চওড়া, গাট্টাগোট্টা ধরনের আর ভালুকের মতো লোমশ দেহ। আর আমাদের নেতা ছিলেন ছোটখাট হালকা-পাতলা গড়নের, তারের মতো পাকানো দেহ। সেনাপতির কাছে এসে শিবাজি একটু ঝুঁকলেন। আর সেনাপতি মুখে চওড়া হাসি নিয়ে দুই হাত দুই দিকে মেলে এগিয়ে গেলেন, যেন তাকে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছেন। ঠিক তখনই একটি ধাতুর ঝিলিক চোখে পড়লো। আফজাল খান তার চওড়া আস্তিনের মধ্যে একটি ছোরা লুকিয়ে রেখেছিলেন, এখন সেটা বাগিয়ে শিবাজির বুক বরাবর আঘাত হানলেন। কিন্তু তুমি তো জান শিবাজি কিরকম দ্রুত আর ক্ষিপ্রতাসম্পন্ন। তিনি ঝট করে পেছনে শরীর দোলালেন। ধারালো ছুরিতে কেবল তার নীল আলখাল্লাটি সামান্য কেটে গেল। আমি আমার লোকজনসহ এক লাফে দাঁড়িয়ে অস্ত্র নিয়ে সামনে ছুটলাম। এদিকে শিবাজি আফজাল খানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আফজাল খান আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন, সাদা আলখাল্লা লাল টকটকে রক্তে ভিজে গেল।